
30/04/2025
👉রাখাইনে মানবিক করিডোর কি?
রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত ও মানবিক সংকটের প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের কাছে একটি "মানবিক করিডোর" স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হবে, বিশেষ করে যেসব এলাকা বর্তমানে সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত।
কী হচ্ছে রাখাইনে?
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (AA) মধ্যে তীব্র সংঘাত চলছে। AA বর্তমানে রাখাইনের প্রায় ৮০% এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সংঘাতের ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে সম্মতি জানিয়েছে, তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে। এই শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে রাখাইনে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, এই করিডোর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে এবং এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাতীয় ঐক্য ও পরামর্শ প্রয়োজন ছিল।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, যেমন রেড ক্রস, বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে। তবে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।
✅ বাংলাদেশের সম্ভাব্য সুবিধা:
1. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশ মানবিক করিডোরের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে যে, এটি একটি দায়িত্বশীল ও মানবিক রাষ্ট্র, যা আঞ্চলিক শান্তি ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী।
2. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা জোরদার
রাখাইনে যদি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় এবং সেখানে সহায়তা পৌঁছায়, তবে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় একটা সাফল্য হবে।
3. কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করা
বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে, এর কূটনৈতিক প্রভাব ও মর্যাদা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাড়বে।
4. সংঘাতের বিস্তার রোধ
রাখাইনে সংঘাত বাড়লে তা বাংলাদেশ সীমান্তেও প্রভাব ফেলতে পারে। করিডোরের মাধ্যমে সেখানে সহায়তা পৌঁছালে যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে, যা সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক।
5. মানবিক ভূমিকা পালন করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ
দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ একটি নৈতিক ও মানবিক ভূমিকার দেশ হিসেবে চিত্রিত হতে পারে।
⚠️ বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ:
1. সার্বভৌমত্বের হুমকি
মানবিক করিডোরে বিদেশি সংস্থা বা বাহিনী (যেমন জাতিসংঘ বা NGO) সক্রিয় হলে বাংলাদেশের ভেতরে বা সীমান্তে বিদেশি হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে।
2. আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা
করিডোর খোলা হলে সংকটময় পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পারে। এতে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত এলাকার চাপ আরও বাড়বে।
3. আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় জড়িয়ে পড়া
রাখাইনের সংঘাতে বড় শক্তিগুলোর (যেমন চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র) কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িত। করিডোরে সক্রিয় হলে বাংলাদেশ অনিচ্ছায় এসব ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
4. বিদেশি এনজিও ও সংস্থার অতিরিক্ত উপস্থিতি
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কার্যক্রম চালাতে পারে, যাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সীমিত হতে পারে। এটি আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
5. বিরোধী রাজনৈতিক চাপ ও বিভাজন
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো করিডোর ইস্যুকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
6. দায়ভার নেওয়ার আশঙ্কা
আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে একমাত্র ‘সাহায্য প্রদানকারী করিডোর’ হিসেবে দেখলে, ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে।
🔍 সারসংক্ষেপ:
মানবিক করিডোর একটি নৈতিক ও মানবিক উদ্যোগ হলেও, বাংলাদেশের জন্য এটি কৌশলগতভাবে জটিল। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নিরাপত্তা, কূটনীতি, আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সমীকরণ—সবদিক বিবেচনায় রাখতে হবে।