30/11/2023
নাটোরের কাঁচাগোল্লার খোঁজে
===================
সৈয়দ আখতারুজ্জামান
===================
[লেখাটি দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। এখানে কিঞ্চিত পরিবর্ধিতরূপে আছে]
***
গাড়ি ছুটছে। বরেন্দ্র জাদুঘর হয়ে গোদাগাড়ীর দিকে। গোদাগাড়ী হয়ে চলে যাব সোজা পুঠিয়া রাজবাড়ি। পুঠিয়া রাজবাড়ি থেকে নাটোর যাব। আর যেহেতু নাটোরই যাচ্ছি, সেহেতু অবধারিতভাবেই মনের গহীন কোণে নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লার মুখটা বেশ উঁকি-ঝুকি মারছে। বাঙালির রসনা বিলাস নিয়ে বেগম রোকেয়া শতবর্ষ আগে থেকেই ভবিষ্যতবানী করে গেছেন – গুরুবাণী তাই মাথা পেতে নিয়েছি, অভ্যেস পাল্টানোর কোন রকম সাধনা করছি না।
রাজশাহী থেকে নাটোর যাওয়ার পথে দেখতে দেখতে যাব বলেই গাড়ি ভাড়া করেছি ইচ্ছামতো ঘোরার জন্য। বাসে যাইনি। এবারের মিশন হলো নাটোরের আসল কাঁচাগোল্লা কোথায় পাওয়া যায় সেটা খুঁজে বের করা। মনে আছে, এর আগে কুমিল্লার রসমালাই, বগুড়া আর গৌড়নদীর দই খুঁজতে গিয়ে কী অবস্থা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিগড়ের আসল ল্যাংচা খোঁজার অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। আসল নামের সঙ্গে আদি, নতুন, আসল, ঘর, বিতান, আলয় ইত্যাদি শব্দযোগে প্রায় অর্ধশত দোকানের উপস্থিতি থাকায় কোন দোকানে যে আসল খাবারটি পাওয়া যাবে, সেটা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। সকলেই বলে আমরাই আসল। সেই হিসাবে সকলেই আসল। নকলের ভিড়ে আসল লুকালে কোনটা সঠিক আসল সেটা বের করা আসলেই কঠিন হয়ে যায়। ফলে সময় নিয়ে যেতে হয়, এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, নিজেকেও খাবারের স্বাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হয়।
ভাবছেন, ধানভানতে শিবের গীত! কাঁচাগোলার খবর কোথায়! হ্যাঁ, ভ্রমণের ফাঁকে রসগোল্লা এসে যাবে এক সময়। ততক্ষণে পুঠিয়ার রাজবাড়িটা দেখে নেই একবার। তারপর নাটোর যাওয়া হবে। তারপর রসগোল্লা আসবে।
পুঠিয়া রাজবাড়ি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন। কারুকার্যময় এই বাড়ির দরবার ঘর বেশ বড়, আছে জলসা ঘর, নকশা কাটা গেট। পাশে আছে বড় দিঘি। পিতাম্বর বাঘ এই পুঠিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পাশেই পাঁচআনি জমিদারবাড়ি। যেখানে আছে একটি গোবিন্দ মন্দির। মন্দিরটি দেখতে দারুণ। এই মন্দিরের সামনে আরেক বিশাল দিঘি। নাম ক্ষীরসাগর দিঘি। দিঘিতে মন্দিরের ছায়া পড়ে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য তৈরি করেছে। পুঠিয়ার রাজবাড়ি মানে রানি ভবানীর প্রাসাদ দেখা। এই রানি ভবানীকে নিয়েও বহু রোমহর্ষক কাহিনি প্রচলিত আছে। তিনি তখনকার সময়ে সবচেয়ে প্রতাপশালী রানি ছিলেন।
বিকেল সাড়ে ৩টা এরই মধ্যে বেজে গেছে। গাড়ি ছুটল নাটোরের পথে। নাটোরের রাজবাড়িতে ঢুকে একরকম বিস্মিতই হলাম। কোথায় পুরাকীর্তি, কোথায় ঐতিহ্য আর প্রাচীন ইতিহাসের গা ছমছমে গন্ধ! এখানে যে শত শত লোক সুপার হিট হিন্দি গান বাজিয়ে চিকেন বিরিয়ানি খেতে খেতে পিকনিক করছে। সারা মাঠ আর রাস্তায় ছড়ানো বিরিয়ানির প্যাকেট আর পলিথিন! গেট দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশে বড় দিঘি; সামনে সাইনবোর্ড লেখা—‘এই দিঘিতে নৌকা ভ্রমণ হয়’। কিন্তু কোথাও তো কোনো নৌকা দেখতে পেলাম না। ও হ্যাঁ, একটা আছে বৈকি! তবে ভাঙা, অব্যবহৃত, তলাফুটো, একটা শ্যাওলা মাখা নৌকা আধডোবা অবস্থায় ঘাটের অদূরে পড়ে থাকতে দেখলাম। এই হচ্ছে নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি। ৪০০ বছরের পুরনো। যত যাই হোক, আমার কাছে আঞ্চলিক প্রশাসনের মস্তিস্কের থেকে জায়গাটা বেশ চকচকে লাগছিলো।
রাজবাড়িতে ঢুকতে প্রথমেই তোরণ আর তার মাঝখানে কামান চোখে পড়বে। পাশে সেই দিঘি। ভেতরে আছে দরবার ঘর, জলসা ঘর, অন্দর মহল, শ্বেত পাথরের নারী ভাস্কর্য, প্রার্থনা ঘর আর রাজাদের ব্যবহৃত নানা দ্রব্য। সব কিছুই দেখার মতো। শুধু একটু পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি থাকলেই হতো! সবকিছুর শেষ পরিনতি পিকনিক স্পট না হলেই ভালো হয়। রাজবাড়ি ঘিরে প্রায় ৫০ বিঘার এক বিশাল জলাশয়। পরিকল্পনা করলে এই লেকটিরও দারুণ চেহারা দেওয়া সম্ভব। আমরা ৩০ মিনিটের মধ্যে এক চক্কর লাগালাম। এবার আসল কাজ। কাঁচাগোল্লার খোঁজে বের হলাম।
প্রায় সব বিখ্যাত খাবারের মতো কাঁচাগোল্লারও আসল-নকল, ভালো-মন্দ আছে। নাটোরের সুসজ্জিত মিষ্টির দোকানের প্রায় সব কয়টিতেই কাঁচাগোল্লা আর সন্দেশ পাওয়া যায়। তবে সবটা আসল বা সুস্বাদু নয়। আমরা গোটা দশেক দোকানে হানা দিলাম, কিন্তু কোথাও সেই অসাধারণ স্বাদের কাঁচাগোল্লা পেলাম না। এবার নানাজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলাম। একসময় অতি বৃদ্ধ এক হিন্দু ভদ্রলোক আমাদের একটা দোকানের কথা বললেন। এবার আমরা তাঁর বর্ণনামতো খুঁজে খুঁজে সেই দোকানের সামনে হাজির হলাম এবং মন খারাপ হয়ে গেল। কী ভাঙাচোরা, জরাজীর্ণ, পুরনো এক দোকান। বসার জায়গা তো দূরের কথা, ঠিকমতো দাঁড়ানোর জায়গাও হবে না। কী অবস্থা! তবুও খেতে চাইলাম। ছোটখাটো-পেটমোটা খালি গায়ে ঘামে ভেজা এক লোক কলাপাতায় করে একটি কাঁচাগোল্লা খেতে দিল। কলাপাতায় পরিবেশন করা হয়, এটাই এই দোকানের নিয়ম। আমি অনিচ্ছা নিয়েই মুখে পুরলাম। মুখে দেওয়ামাত্র মনে হলো বৈদ্যুতিক শক খেলাম। কী দারুণ তার স্বাদ! আহা চোখ বুজে এলো। এই না হলে নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা! অন্যান্য দোকানের স্বাদের সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না। নাম তার ঘোষের কাঁচাগোল্লা। এখানে সন্দেশও পাওয়া যায়। অসাধারণ। আমরা বিভিন্ন রকমের সন্দেশ আর কাঁচাগোল্লা কিনে নিলাম। লম্বা লাইন দোকানের বাইরে। বিস্ময়কর ব্যাপার দোকানটির কোনো সাইনবোর্ড নেই। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে যে দোকান চলছে এবং সারা দেশ যাকে চেনে তার আবার সাইনবোর্ড দিয়ে কী হবে! যাঁরা আসল কাঁচাগোল্লা খেতে চান, তাঁরা নাটোর বাসস্ট্যান্ড থেকে সামনে এগোলে মৌচাক নামক জায়গায় পেয়ে যাবেন দোকানটি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমরা এবার বগুড়া রওনা হওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম। অকাজের তাড়নায় দুপুর খাওয়া হয়নি। রাস্তার ধারে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে হালকা কিছু নাশতা করে নিলাম—পরোটা, সবজি। তারপর গাড়ি ছুটল বগুড়ার দিকে। দারুণ একটি দিন কাটালাম। সকালে সপুরা সিল্ক ফ্যাক্টরি আর বিকেলের এই কাঁচাগোল্লার দোকান আবিষ্কার আমাদের ভ্রমণকে সার্থক করল।
@ Syed Akhteruzzaman
[নিজের তোলা ছবির সংগ্রহটি দেশে রয়ে গেছে। আন্তরিকভাবে দুঃখিত। পরে কোন এক সময় নিজের তোলা ছবিগুলো পোস্টে যোগ করার চেষ্টা করবো। আপতত অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করে ছবিটি পোস্ট করলাম, সেখানে ও লেখা 'সংগৃহীত'।]