06/07/2025
২০২৫ সালের জুলাই মাসের ৬ তারিখ, শুক্রবার সকালে সুন্দরবনের বুকে নৌকা ভাসিয়েছিলাম আমরা ক'জন বন্ধু। দিনের বেলায় বনের যে রূপ দেখেছি, রাতের গভীরে সে এক ভিন্ন জগত। সেদিনের রাতটা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা হয়ে থাকবে।
সন্ধ্যা নামার পর আমাদের নৌকাটা একটা খালের প্রায় শেষ মাথায় নোঙর করা হলো। চারপাশে ম্যানগ্রোভের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, জোনাকির মিটিমিটি আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক। ভরা পূর্ণিমা ছিল না, তাই আকাশ ছিল তারায় ভরা। আমরা সবাই নৌকার ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসেছিলাম।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। হঠাৎ করেই পিনপতন নীরবতা নেমে এল চারপাশে। জোনাকিরা উধাও, ঝিঁঝিঁদের ডাক বন্ধ। আমরা ক’জন একে অপরের দিকে তাকালাম। একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয় মেশানো অনুভূতি। আমাদের গাইডের ফিসফিস করে বলা কথাগুলো যেন নীরবতার ভার আরও বাড়িয়ে দিল, "সাবধান, বাঘ মামা আশেপাশে থাকতে পারে।"
ঠান্ডা একটা শিরশিরানি বয়ে গেল সবার গায়ে। ঠিক তখনই, খালের অপর পাড়ে, বনের ভেতরের গভীর থেকে একটা চাপা গর্জন ভেসে এল। শব্দটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, মনে হচ্ছিল আমাদের নৌকার ছাদ কাঁপছে। মুহূর্তের জন্য সবাই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই আরেকটা গর্জন, এবার যেন আরও কাছে। গাইড টর্চলাইট জ্বেলে বনের দিকে ফেললেন, কিন্তু ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ভেদ করে কিছুই দেখা গেল না।
আমরা সবাই একে অপরের হাত শক্ত করে ধরেছিলাম। ওই কয়েকটা মিনিট যেন জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ আর উত্তেজনাপূর্ণ সময় ছিল। বাঘের সেই গর্জন, রাতের বনের নিস্তব্ধতা আর আমাদের হৃদপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন – সব মিলে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই গর্জন থেমে গেল। বনের নীরবতা ফিরে এল, কিন্তু সেই নীরবতা আর আগের মতো ছিল না। তাতে মিশে ছিল প্রকৃতির অপার রহস্য আর বন্য প্রাণের অদৃশ্য উপস্থিতি।
সেদিন রাতে ঘুম আসেনি কারও চোখে। সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া সেই অজানা ভয় আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি আজও স্পষ্ট মনে আছে। প্রকৃতির কোলে এমন ভয়ংকর সুন্দর অভিজ্ঞতা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।