ঐতিহ্যের নগরী সিলেট
রাশেদীন ফায়সাল: সুরমা-কুশিয়ারার জলে ভেজা সিলেট প্রাচীন কাল থেকেই এক সমৃদ্ধ জনপদ। হাজার বছরের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে লালিত এ জনপদকে প্রকৃতিও যেনো নিজের মতো করে সাজিয়েছে। আর শাহজালালের (রহ.) চরণ স্পর্শে এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছায়াময় পরিবেশ। জালালি কইতরের ডানা ঝাপটানো আর বাক-বাকুমে ঘুম ভাঙে এখানকার অধিবাসীদের, কমলা লেবু আর চায়ের পাতার ঘ্রাণ পাগল করে তোলে তাদের হৃদয়। প্রকৃত
ির কোলে বেড়ে উঠা এ জনপদের মানুষের কণ্ঠে তাই খেলা করে প্রকৃতিরই সুর। তাই সুরমার তীর ভরে উঠে হাছন-রাধা রমন আর করিমের দরাজ কণ্ঠে। সিলেটকে আলাদা পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন না থাকলেও কিছু ঐতিহ্য, স্থান, স্থাপনা সিলেটকে আলাদা পরিচয়ে অনন্য করে তুলেছে। পুরো সিলেট বিভাগজুড়েই জুড়েই ছড়িয়ে আছে প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের নিদর্শন। এসব নিদর্শনের অনেকগুলোই রয়েছে নগর সিলেটে। কিন ব্রিজ : সুরমা নদীর উপর অবস্থিত কীন ব্রিজ সিলেটের প্রবেশদ্বার হিসেবেই পরিচিত। এক সময় এ ব্রিজটি সিলেটেরই অন্য পরিচয় হয়ে উঠেছিলো। সময়ের পরিক্রমায় কীন ব্রিজের সে জৌলুস আর থাকলেও এটি এখনও সিলেটের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অংশ হয়ে সুরমার বুকে টিকে আছে। ১৯৩৬ সালে আসামের শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল হামিদ এবং আসামের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য বাবু প্রমোদ চন্দ্র দত্তের উদ্যোগে ব্রিজটি তেরি হয়। ব্রিজটি উদ্বোধন করেন আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কীন (গরপযধবষ কবধহব)। তার নামেই ব্রিজের নামকরণ করা হয়। তবে ব্রিজটি সুরমা ব্রিজ নামেও ব্যাপক পরিচিত। স্টিলের তৈরী এই ব্রিজটি দৈর্ঘ্যে ৩৯৫ মিটার এবং প্রস্থে ৫.৫০ মিটার। তৎকালীন সময়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। আলী আমজাদের ঘড়ি : কীন ব্রীজের পাশেই চাঁদনীঘাটে রয়েছে সিলেটের আরেক ঐতিহ্য আলী আমজাদের ঘড়ি। কীন ব্রিজ থেকে নীচের দিকে তাকালে, চাঁদনী ঘাটের কাছেই চোখে পড়ে আলী আমজাদের ঘড়ি। ঘড়িটি নির্মিত হয় ১৮৭৪ সালে। সে সময় তৎকালীন বড়লাট লর্ড নর্থ ব্রুক সিলেট সফরে এলে তার সম্মানে এ ঘড়ি নির্মাণ করা হয় আলী আমজাদের জমিদারীর তহবিলের অর্থ থেকে। তাই এ ঘড়িটি আলী আমজাদের ঘড়ি হিসেবেই পরিচিত। ঘড়ির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। এ অঞ্চলে যখন ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না, মানুষ সূর্যের দিকে তাকিয়ে সময় আন্দাজ করতো, ঠিক সে সময় এ ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি নির্মিত হয়। সে আমলে মানুষজন শহরের প্রবেশপথে স্থাপিত ঘড়িঘরের সময় দেখে শহরে আসা-যাওয়া ও কাজকর্ম সম্পাদন করতেন। লোহার খুঁটির ওপর ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির এ মনোরম স্থাপত্যশৈলীর পরিচায়ক ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজাদের ঘড়িঘর নামে পরিচিতি লাভ করে। বিরাট আকারের ডায়াল ও কাঁটা সংযুক্ত সুবিশাল ঘড়িটির ঘণ্টাধ্বনি শহরের বাইরে অনেকদূর থেকেও শোনা যেত। সারদা হল : সিলেটের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজ সেবক সারদাচরণ শ্যামের স্মরণে ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম স্তম্ভ সারদা হল। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারদাচরণের স্মৃতি বিজড়িত এ মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই এক কালে সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকা- আবর্তিত হত। কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের আদলে গড়ে উঠা এ মিলনায়নের মোট জায়গার পরিমাণ ৩৯ শতক। সুরমা পারের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সারদা আজও টানে সিলেটে সংস্কৃতিপ্রিয়দের। শাহী ঈদগাহ : সিলেটের শাহী ঈদগাহ দেশের প্রাচীনতম একটি ঈদগাহ। মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ মনোমুগ্ধকর কারুকার্যময় এ ঈদগাহটি নির্মাণ করেন। ২২টি সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঈদগাহের মূল এলাকায় উঠতে হয়। এরপরই ১৫টি গম্বুজসজ্জিত ঈদগাহ। এখানে এক সাথে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লী ঈদের জামাত আদায় করতে পারেন। এছাড়াও অন্য আরেক কারণে ইতিহাসে এ ঈদগাহ আলাদা স্থান করে নিয়েছে। ১৭৮২ সালে এখানে সৈয়দ মোহাম্মদ হাদী (হাদা মিয়া) ও সৈয়দ মোহাম্মদ মেহেদী (মাদা মিয়া) ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। ইংরেজদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শহীদ হন। জিতু মিয়ার বাড়ি : চাদঁনী ঘাটের সিঁড়ি/আলী আমজাদের ঘড়ি/ বঙ্কু বাবুর দাড়ি/ আর জিতু মিয়ার বাড়ি সিলেটের পরিচিতিতে বহুল প্রচলিত এমন লোকগাঁথা। সিলেট নগরীর শেখঘাটে কাজিরবাজারের দক্ষিণ সড়কের ধারে ঐতিহ্যবাহী জিতু মিয়ার বাড়ি। চুন সুরকি দিয়ে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন এ দালানটি নির্মাণ করেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। ১৯৯১ সালে এ বাড়ির সামনের দালানটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমান কাজিরবাজার গরুর হাট ছিল কাজিদের মূল বাড়ি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বাড়িটি ল-ভ- হয়ে গেলে বর্তমানে জায়গায় বাড়িটি স্থানান্তরিত হয়। মণিপুরী রাজবাড়ি : নগরীর একেবারে মধ্যখানে মির্জাজাঙ্গালে মণিপুরী রাজবাড়ির অবস্থান। মণিপুরী সম্প্রদায়ের শৌর্যবীর্যের প্রতীক হয়ে রাজবাড়িটি এখনও কোনোমতে টিকে আছে। ঊনিশ শতকে নির্মিত এ রাজবাড়িটি প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অনন্য এক নির্দশন। রাজ্যহারা মণিপুরী মনিপুরী রাজবংশের তিন উত্তরপুরুষ রাজা চৌর্জিৎ সিং, মার্জিত সিং ও গম্ভীর সিং ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন। পরে এ তিন ভাইয়ের মধ্যে চৌর্জিৎ সিং ও মার্জিত সিং কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। গম্ভীর সিং এ রাজবাড়িতেই রয়ে যান। বৃটিশ সরকারের সহযোগিতায় ১৮২৬ সালে বার্মার সাথে যুদ্ধ করে মনিপুর রাজ্য পুরুদ্ধারের পর গম্ভীর সিং ফিরে যান আপন আলয়ে। মণিপুরী রাজবাড়িটি কেবল প্রাচীন এক নিদর্শনই নয়, মণিপুরী সম্প্রদায়ের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এক অংশও এটি। তবে সময়ের পরিক্রমায় রাজবাড়ির তিন চতুর্থাংশের কোন অস্তিত্ব নেই। তবে রাজবাড়ির প্রধান ফটক, সীমানা দেয়াল, কারুকার্যখচিত সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ কোনোমতে তার সোনালী অতীতের জানান দেয়। মণিপুরী ঠাকুর ও ব্রাহ্মণ পরিবারের লোকজন বর্তমানে বংশ পরম্পরায় এ বাড়িটিতে বাস করছেন।