08/01/2025
বর্তমানে বৈশ্বিক ভ্রমণ ও ভিসা পরিস্থিতি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ ও সীমাবদ্ধতা চালু হওয়ায় দেশের বাইরে ভ্রমণ করাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
চলুন এক নজরে দেখি কোন কোন দেশ ভ্রমণে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এখন বেশি কষ্টকর এবং কোন দেশে যেতে কিছুটা সহজলভ্যতা রয়েছে।
১. ভারত:
ভারতীয় টুরিস্ট ভিসা প্রায় বন্ধ বলা চলে, এবং যারা আবেদন করেন, তাদের ক্ষেত্রেও ভিসা পেতে কয়েক মাসের অপেক্ষার ঝামেলা। শিক্ষার্থী ও চিকিৎসা ভিসার জন্যেও এখন বেশ কড়াকড়ি রয়েছে।
২. মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো:
সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, এবং জর্ডানের মতো দেশগুলোতে বর্তমানে টুরিস্ট ভিসা কার্যত বন্ধ। এখানকার রেসিডেন্স কার্ড থাকলেও এখন অনেক দেশে অন-অ্যারাইভাল সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে, যা আগে বিভিন্ন দেশে প্রযোজ্য ছিল।
৩. কেন্দ্রীয় এশিয়া:
২০২৩ সালে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ বিভিন্ন দেশ ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের প্রতি আগ্রহ দেখালেও কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উজবেকিস্তানও নতুন করে ইনভাইটেশন প্রসেস চালু করলেও বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে অনেকটা কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে।
৪. কানাডা:
সাম্প্রতিক কালে কানাডায় ভিসা নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কানাডার স্টুডেন্ট ও টুরিস্ট ভিসার ক্ষেত্রে আগে যেখানে দ্রুত ভিসা মঞ্জুর হতো, এখন অনেকের আবেদন পুনঃবিবেচনা ছাড়াই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
৫. ইউরোপীয় দেশগুলো:
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ভিসা পেতে এখন তীব্র যাচাই-বাছাই চলছে, ফলে ভিসা অনুমোদনের হার কমে প্রায় ১৫% এ নেমে এসেছে। প্রাপ্তির মধ্যে অনেকেই আর ফিরে আসেন না, যার ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হয়ে গেছে।
৬. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া:
মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমণ ভিসা সহজলভ্য হলেও ইমিগ্রেশন চেকিংয়ে বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত যাচাই করা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে কাউন্টারে নেয়া হয়, যা ভ্রমণকারীদের জন্য কিছুটা বিব্রতকর।
৭. নেপাল:
নেপালে যেতে এখনো কোন বাধা নেই, তবে কিছু বাংলাদেশি নেপালি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করায় নেপালের ইমিগ্রেশন কিছুটা কঠোর হয়েছে।
৮. অস্ট্রেলিয়া:
অস্ট্রেলিয়ান ভিসার ক্ষেত্রে সাধারণত ৯৫% আবেদন এখন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। শিক্ষা বা অন্যান্য ভিসা আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে ছোটখাটো অসঙ্গতির জন্যও রিজেকশন হচ্ছে।
৯. যুক্তরাজ্য:
যুক্তরাজ্যের ভিসা পেতে স্টেটমেন্ট ও অন্যান্য আর্থিক প্রমাণপত্রের কড়াকড়ি বাড়ানো হয়েছে। বেশিরভাগ আবেদনকারীরই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশনের ঘাটতি থাকায় আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
১০. বসনিয়া ও সার্বিয়া:
অনেক বাংলাদেশি এই দেশগুলো হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন, ফলে বসনিয়া ও সার্বিয়ার জঙ্গলে বা জাতিসংঘের ক্যাম্পে বহু বাংলাদেশি আটকা পড়ে থাকে বছরের পর বছর।
১১. পানামা:
মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার জঙ্গল পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টার ফলে বহু বাংলাদেশি সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন।
১২. ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো:
অনেক বাংলাদেশি এই দেশগুলোতে বসবাস করেন মূলত যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর আশায়, কিন্তু বাধা বা আইনি ঝামেলায় আটকা পড়েন।
১৩. লিবিয়া ও ইতালি:
লিবিয়া হয়ে ইতালিতে ঢোকার প্রবণতা সম্পর্কে প্রায় সকলেই জানেন, তবে এটি অত্যন্ত বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এই রুটটি নিয়ে স্থানীয় সরকারগুলিও সতর্ক।
১৪. আফ্রিকা:
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, বা দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনও ভিসা পেতে কিছুটা সুবিধা আছে। তবে মরক্কোর মতো দেশ যাদের ইউরোপের সাথে স্থল সীমান্ত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিবাসী সংক্রান্ত সমস্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা:
শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে অন-অ্যারাইভাল ভিসা আবার চালু হলেও পূর্বের তুলনায় কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে শ্রীলঙ্কায় যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের জন্য কিছুটা হলেও সুসংবাদ আছে।
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যেসব দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই সব দেশে যাবার আগে সঠিক তথ্য যাচাই করে পরিকল্পনা করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয়:
নিরাপদ ভ্রমণ ও সঠিক ভিসা প্রক্রিয়া অনুসরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
যেসব দেশে এখনো ভিসা সুবিধা রয়েছে, সেগুলোতে নিয়ম মেনে প্রবেশ করা জরুরি।
অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টার কারণে ভবিষ্যতে আরো দেশ ভিসা বন্ধ করতে পারে, তাই এমন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা উচিত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নত করা, সঠিক প্রক্রিয়ায় ভ্রমণ করা এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য বর্তমান ভিসা সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু করণীয় বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। এই সংকট কাটিয়ে নিরাপদে এবং বৈধ উপায়ে বিদেশ ভ্রমণ বা স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করলে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ:
১. বিশ্বাসযোগ্য এবং বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করুন:
প্রতিটি দেশের ইমিগ্রেশন নিয়ম এবং ভিসা নীতিমালা ভিন্ন হতে পারে, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই আপনি যে দেশে যেতে চান, সেই দেশের ভিসা পলিসি, প্রবেশাধিকার, এবং ইমিগ্রেশন নীতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করুন। প্রয়োজন হলে কোনো বিশ্বস্ত ট্রাভেল এজেন্ট বা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
২. আর্থিক প্রস্তুতি ও নথি সঠিক করুন:
প্রায় সব দেশেই ভিসার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসরশিপ লেটার, কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তথ্য, এবং আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণপত্র জরুরি। আপনার সকল আর্থিক ও ব্যক্তিগত নথি সঠিক ও আপডেট রাখুন এবং যথাযথভাবে উপস্থাপন করুন। বিশেষ করে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিসার ক্ষেত্রে স্টেটমেন্ট এবং অন্যান্য আর্থিক কাগজপত্র বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
৩. উদ্দেশ্যনির্ভর ভিসা আবেদন করুন:
কাজ, শিক্ষা, বা চিকিৎসার জন্য যেসব দেশে সুযোগ আছে, সেসব দেশেই বিশেষ উদ্দেশ্যভিত্তিক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। টুরিস্ট ভিসার পরিবর্তে শিক্ষাগত বা পেশাগত ভিসার সুযোগ খুঁজতে পারেন। সঠিক এবং আইনানুগ উপায়ে স্পনসর অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ইনভাইটেশন বা অ্যাডমিশন নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।
৪. ইমিগ্রেশন নীতি অনুসরণ করুন:
অন্য দেশে গিয়ে ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গ করা বা স্থানীয় নিয়ম-কানুন না মানা পরবর্তীতে আপনার এবং অন্য বাংলাদেশিদের ভিসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধার কারণ হতে পারে। তাই বৈধ এবং আইনানুগ পথে কাজ করুন এবং ইমিগ্রেশন নীতি মেনে চলুন।
৫. পরিকল্পনা করে আফ্রিকার দেশগুলোতে যাত্রা বিবেচনা করুন:
আফ্রিকার কিছু দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা পাওয়ার সুযোগ এখনও রয়েছে। তবে এ ধরনের ভ্রমণ পরিকল্পনার আগে ওই দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট এবং সুসংহত থাকা বাঞ্ছনীয়।
৬. অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব থেকে সাবধান থাকুন:
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভিসা প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হতে পারে। সঠিক তথ্যের জন্য সরকারি ওয়েবসাইট, দূতাবাস, বা অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীদের পরামর্শ অনুসরণ করুন। গুজবে না গিয়ে প্রমাণিত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন।
৭. স্থায়ী আবাসন বা PR এর জন্য কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রক্রিয়া ভালভাবে জানুন:
যেসব দেশে স্থায়ী আবাসনের জন্য সুযোগ থাকে, সেখানে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে আবেদন করা যায়। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী বসবাসের জন্য Express Entry বা নির্দিষ্ট কাজের যোগ্যতার ভিত্তিতে আবেদন করতে পারেন। তবে এখানেও যথাযথ নথি ও সঠিক যোগ্যতা যাচাই খুবই জরুরি।
৮. শিক্ষাগত স্কিল উন্নয়ন ও ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি:
উন্নত শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভাষাগত দক্ষতা (যেমন ইংরেজি বা ফরাসি ভাষা) আপনাকে কিছু দেশের ভিসা প্রক্রিয়ায় সুবিধা দিতে পারে। IELTS, TOEFL, বা অন্যান্য ভাষাগত সার্টিফিকেশন অনেক দেশে পড়াশুনা বা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয়।
৯. ক্যাম্পিং ও অবৈধ পদ্ধতি পরিহার করুন:
কোনো দেশেই অবৈধ পদ্ধতিতে বসবাসের চেষ্টা করবেন না। বিশেষ করে ইউরোপ বা আমেরিকার উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে যাত্রা বা ক্যাম্পিং করা অত্যন্ত বিপদজনক। এ ধরনের কাজ আপনাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে এবং দেশে ফিরতে বাধ্য হতে পারেন।
১০. দূতাবাস বা কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন:
ভ্রমণ বা বিদেশে অবস্থানের সময় যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে নিজের দেশের দূতাবাস বা কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে।
উপসংহার:
এই বৈশ্বিক সংকটময় সময়ে সঠিক পরিকল্পনা ও আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভ্রমণ বা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিরাপদ ও স্থায়ী ভিত্তিতে সফল অভিবাসনের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে নেওয়া উচিত।