26/02/2024
আমার বোন ইতু আমার চেয়ে ছয় মিনিট একত্রিশ সেকেন্ডের ছোট। পুরো পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমাদের জন্ম। মা সন্তান সম্ভাবা হবার পর দাদিজানের বদ্ধমূল ধারনা ছিল ছেলে হবে, কিন্তু তাকে হতাশ আর আশাহত করে আমরা দুবোন পৃথিবীতে এলাম।
পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও গুঞ্জন, প্রথমেই মাইয়া হইল ! তাও আবার দুইডা ! দাদীজান এসব মন্তব্য শুনে আরও বেশী উস্কে থাকতেন ! মায়ের প্রতি অহেতুক অসন্তুষ্টি দেখানোর ক্ষেত্রে একটা নতুন মাত্রা যোগ হল যেন। কপালে বিরক্তির ছাপ নিয়ে সামনের খোলা বারান্দার চকিটাতে পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন সারাক্ষণ। আমরা দুবোন যখন খিদেয় তার স্বরে চিৎকার করতাম, তার কপালে ভাঁজের সংখ্যা দ্বিগুণ হোত। খেদ নিয়ে বলতেন—“দুই মাইয়া তো ওসমানরে পথের ফকির বানায়ে দিব ! এত্ত খিদা লাগে ক্যান এগো !”
আমার মা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন এসব শুনে, প্রতিউত্তর করার স্বভাব কখনওই ছিলনা তার।
আমার বাবা সৈয়দ ওসমান সিরাজ পেশায় পোস্ট মাষ্টার ছিলেন। খুব হাসিখুশি, প্রাণখোলা একজন মানুষ। মেয়ে হবার কারনে তিনি অসন্তুষ্ট বা বিচলিত ছিলেন না একদমই। আমাদের দুবোনকে একসাথেই কোলে নিতেন, ছড়া কেটে কেটে আদর করতেন ঘুম পাড়াতেন।
মাকে ঘরের কাজে, আমাদের লালন পালনে সাহায্য করত রাহিলা বু। মূলত তার কাছ থেকেই আমাদের জন্মের পরের ঘটনা গুলো শোনা। আমাদের দুবোনকে অনেক আদর করতেন উনি।
জমজ হলেও আমাদের দুবোন দেখতে একেবারেই ভিন্ন ছিলাম, কোন মিল ছিলনা চেহারায়। ইতুটার গায়ের রঙ ছিল টকটকে ফর্সা, খাড়া নাক, টানা চোখ ! পাশাপাশি আমার গায়ের রঙ ছিল শ্যামবর্ণের, জাপানিদের মত বোঁচা নাক ! সবাই খুব অবাক হত, পাশের বাড়ীর মালতী মাসীতো দেখলেই বলত –‘নীতুর চেহারা কার মত হইল বলেন তো খালা ! একদম আলাগ !’
এসব কথায় মায়ের ফর্সা মুখে লাল আভা দেখা দিত রাগে, বাসন কোসন থালাবাটির ঝনঝন শব্দে তার বহিঃপ্রকাশ হতো। আর দাদীজানের জমানো জেদ উগড়ে বেরিয়ে আসত, হাহুতাশ করে মালতী মাসীর সাথে গলা মেলাতেন তিনি।
বড় হবার সাথে সাথে আমাদের দুজনের লালল পালনে বেশ কিছু পার্থক্য এল, যেমন—আমাকে প্রতিদিন কাঁচা হলুদ আর দুধের সর মাখিয়ে আধা ঘন্টা বসিয়ে রাখা হত , সরিষার তেল লাগিয়ে নাক টেনে খাড়া করার প্রচেষ্টা চলত দুবেলা ! ইতুর বেলায় এসবের দরকারই পড়ত না। আমার হলুদ মেখে বসে থাকার সময়টায় ইতু পুরো উঠোন দাপিয়ে বেড়াতো।কখনও হাঁসের পেছনে, কখনও ছাগলছানার সাথে দৌড়ে। আ্মি জলচকিতে বসে চুপচাপ দেখতাম ওকে।
কাপড়চোপড় কেনার বেলাতেও ঝামেলা হতে লাগল। ইতুর গায়ে যে কোন রঙের ফ্রক অনায়াসেই মানিয়ে যেত , আর আমার বেলায় যত বাছাবাছি, নির্ধারিত কিছু রঙ ছিল আমার জন্য! হালকা গোলাপি, কুসুম হলুদ কিংবা আকাশী !
একটু বড় হবার পর থেকেই বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করলাম আমি, এবং খুব চেষ্টা করতাম মন খারাপ না করে পরিস্থিতি গুলো মেনে নিতে। বেশ ছোট বয়স থেকেই খাপ খাওয়ানোর অভ্যেসটা রপ্ত হয়ে গেল আমার।
এরমধ্যে আমাদের পরিবারে নেমে এল অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ! বাবা মারা গেলেন। সুস্থ মানুষটা গল্প করতে করতে রাতের খাবার খেলেন। পান চিবোতে চিবোতে দাদীজানের সাথে খানিক্ষণ গল্প করে চলে গেলেন শোবার ঘরে। তার পরপরই মাকে ডেকে বললেন—“খুব হাঁসফাঁস লাগতেছে ! খাওয়া বেশি হয়ে গেছে মনে হয় ! কি করি কওতো !”
মা দৌড়ে রান্না ঘরে গেলেন, লেবু কচলে পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখলেন, বাবার নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। মায়ের চিৎকারে সবাই ছুটে এলাম, ডাক্তার চাচাকে ডেকে নিয়ে এল তখনই পাশের বাড়ীর মন্টু। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ ! বাবা চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে।
বাবার এই হঠাৎ মৃত্যুতে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। দাদীজান একদম ভেঙে পড়লেন, সারাক্ষণ খোলা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন আর থেকে থেকে আর্তনাদ করতেন। মা খুব চুপচাপ হয়ে গেলেন, এই শোকের ধকল কাটাতে অনেক সময় লেগে গেল তার, আর ততদিনে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে কেমন বুড়িয়ে গেলেন মা!
২.
সময়্তো বয়ে চলে তার আপন গতিতে ! আমরা দুবোন বড় হতে লাগলাম একটু একটু করে। হাইস্কুলের গন্ডি পার হয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। ইতুটা দিন দিন ভয়াবহ সুন্দরী হয়ে উঠছিল। আমরা যখন কলেজে যেতাম অগণিত মুগ্ধ চোখ স্থির হতো ওর দিকে, পাড়ার ছেলেগুলো কেমন হা করে তাকিয়ে থাকতো ! ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস টের পেতাম আমি, সেটা গোপন করে হাসতাম আপন মনেই, ভাবতাম- আমারইতো বোন ! তবুও কেন এই অদ্ভুত মন খারাপে আচ্ছন্ন হই বারবার !
মুগ্ধতার এই ব্যাপারটা ইতু নিজেও বেশ ভালই বুঝতে পারত, ওর চোখে প্রচ্ছন্ন একটা পরিতৃপ্তি স্পষ্ট দেখতে পেতাম আমি। আচরণেও কেমন অহংকারী আর বেপরোয়া একটা ভাব ফুটে উঠত, শান্ত আর চুপচাপ থাকা আমি ওর এমন বহিঃপ্রকাশে যেন আরও সংকুচিত হতাম, হীনমন্যতায় গুটিয়ে যেতাম প্রতিনিয়ত।
মাঝে মাঝে নিজেকে দাড় করাতাম আয়নার সামনে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম নীতুকে! পিঠে ছড়িয়ে থাকা লম্বা চুলে,চোখের মায়ায় কিংবা ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটায় যেটুকু স্নিগ্ধতা খুঁজে পেত মন, সেটা বড় নগন্য! ইতুর ঝলমলে দ্যুতি ছড়ানো সৌন্দর্যের কাছে তা ম্লান হয়ে যেত তখনই! অজানা অভিমানে চোখ ভিজে উঠত বারবার, আমার মন খারাপের আকাশ আরও ভারী হত নিকষ কালো মেঘে!
এ বয়সেই অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসছিল ইতুর। পড়াশোনায় যেহেতু বরাবরই অমনযোগী ছিল, তাই দাদীজান সামনের চকিটায় পা ছড়িয়ে বসে বসে প্রায়ই বলতেন—“পড়াশোনা বেশী দূর হইবনা ওরে দিয়া ! বিয়ার জোবা লাগছে যেহেতু, বিয়া দিতাছো না ক্যান মাইয়াডারে ! রুপ দেইখা পাগল হইছে মাইন্সে, সুযোগ কামে লাগাও বউ !"
মা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন ইতুর দিকে, সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ইতু কাঁচা আম বা তেতুল ভর্তার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত।
না চাইলেও ইতু আর আমার পৃথিবী আলাদা হতে লাগল একটু একটু করে। আমাদের মনন স্বভাব আচরণের তফাৎ গুলো দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালো আপনা থেকেই। যে সময়টা ইতু রুপচর্চা, সাজসজ্জা, আর বান্ধবীদের নিয়ে গল্পে আনন্দে পার করত, সে সময়টায় আমি প্রশান্তি খুঁজতাম লাইব্রেরী থেকে আনা গল্পের বই আর মালতী মাসীর কাছ থেকে ধার করে আনা পত্রিকা, ম্যাগাজিন গুলোতে, তৈরী করে নিয়েছিলাম আপন ভুবন।
ম্যাগাজিন গুলোর শেষ পাতায় প্রায়ই ছোট ছোট বিজ্ঞাপন খুঁজে পেতাম—বন্ধু চাই, পত্রমিতালী করতে চাই। দারুণ আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞাপন গুলো পড়তাম। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত কোন এক ঠিকানায় দুলাইন চিঠি লিখে পাঠাই। কিন্তু সাহস করে হয়ে উঠত না। কোথাকার কে, ভাল না মন্দ, এসব ঠিকানা আদৌ সত্যি কিনা এমন হাজারও ভাবনা দ্বিধা-দ্বন্দে শেষ পর্যন্ত আর লেখা হতো না।
ইফতেখার আহমেদ, বয়সঃ ২৭ , জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঠিকানাটা মাথার মধ্যে কেমন করে আটকে গেল ! সারাক্ষনই ঘুরতে লাগল মাথার ভেতর ভাঙ্গা রেকর্ডের মত। হঠাৎ একদিন লিখে ফেললাম দুলাইন ! চুপিচুপি পোষ্ট অফিসে গিয়ে পোষ্টও করে ফেললাম। আমার হাতপা কাঁপছিল রীতিমত।
তারপর অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে শুরু করল প্রতি মুহুর্তে ! যদি সত্যি সত্যি উত্তর আসে ! কি করব তখন ! উৎকণ্ঠায় কাটতে লাগল দিন, তারপর সপ্তাহ। কিন্তু উওর এলোনা, আমার অপেক্ষায় ভাটা পড়ল। একসময় ভুলে গেলাম, মাথা থেকে মিলিয়ে গেল বিষয়টা।
৩.
সামনে পরীক্ষা, মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পুরোপুরি মনযোগী হলাম পড়াশোনায়। বরাবরের রেজাল্ট ধরে রাখাটা অনেক জরুরী আমার জন্য। ঠিক সতের দিনের মাথায় ডাকপিয়ন চাচার গলার আওয়াজ শুনে দৌড়ে বের হলাম ঘর থেকে, আমাকে দেখেই হাঁক দিলেন—“নীতু মা ! তোমার নামে একখান চিঠি আইছে ঢাকা দিয়া !”
আমি তড়িঘড়ি করে চিঠিটা হাতে নিয়েই ছুটে ঘরে গেলাম, লুকিয়ে রাখলাম বইয়ের ভাঁজে। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল তেষ্টায়। চিঠিটা খুলেছিলাম গভীর রাতে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছোট্ট চিঠিটা কতবার যে পড়েছিলাম!
সেই থেকে শুরু ! সময়ের সাথে সাথে একের পর এক খামে আমার ভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন পৌঁছে যেতে লাগল অজানা অচেনা এক শহরে। দিনের পর দিন শুধু লিখেই যাচ্ছিলাম গভীর আগ্রহে, ভাললাগায়। একটা সময় ইফতেখার আর অজানা কেউ রইলনা, মনের সাথে প্রগাঢ় জানশোনার এই মানুষটাকে যেন আমি দেখতে পেতাম ! অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তী আমার কল্পনা জগতে বিচরণ করত সারাক্ষণ।
ন’মাসের মাথায় যে চিঠিটা এল, সেই চিঠির ভাঁজে একটা ছবি পেলাম ইফতেখারের, কি স্নিগ্ধ মায়ামাখা একটা মুখ ! ছোট্ট চিঠিটায় লেখা -----
প্রিয় নীতু,
ভালবাসা জেনো, আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে, পাশ করেছি। পার্ট টাইম একটা চাকরীও পেয়েছি জানো ! আপাতত খারাপ না ! তোমাকে কবে দেখবো বলোতো ! একটা ছবি অন্তত পাঠাতে পারো ! এবার চিঠির সাথে একটা ছবি চাই, দেবে তো ? অপেক্ষায় রইলাম।
, “ ইফতেখার”
আমি গভীর সঙ্কটে পড়লাম। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছিল। আমার চিঠি পড়ে ইফতেখার যতটা মুগ্ধ, আমার ভাবনা স্বপ্নের কথা জেনে যতটা বিমোহিত, চোখের দেখায় সে ঘোর কেটে যাবে নিমিষেই। আমি নিশ্চিত তার কল্পনার নীতু আর বাস্তবতার নীতুর ব্যবধান তাকে আশাহত করবে প্রচন্ডভাবে। আর সেটা অনেক বড় অপমানের , লজ্জার !
অনেক কাঁদলাম আমি, অনেক। তারপর শান্ত হলাম, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম—আজ থেকে আর চিঠি লিখবনা ইফতেখারকে, এটাই একমাত্র উপায়। বন্ধ করে দিলাম যোগাযোগ ! খাটের নীচের পুরানো ট্রাংকে তালা বন্ধ করে দিলাম চিঠিগুলো। যে মানুষটাকে চোখে দেখিনি, কথা হয়নি কখনও তার জন্য হাহাকারে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল ! কি অদ্ভুত ভাবে গভীর ক্ষত তৈরী হল মনে , রাত জেগে তার দগদগে যন্ত্রণা টের পেতাম আমি।
৪.
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হল আমাদের। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দিন রাত পড়াশোনা, প্রস্তুতি, আর পরীক্ষা ! এর মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হল ইতুর বিয়ে ! পরীক্ষার মধ্যেই এসে ছেলেপক্ষ ইতুকে আংটি পড়িয়ে গেল, সিদ্ধান্ত নেয়া হল পরীক্ষা শেষ হলে ভাল দিনক্ষণ দেখে বিয়ের আয়োজন করা হবে।
পাত্র আমাদের কলেজেই ইংরেজী পড়ায়, ইতুকে দেখে খুব পছন্দ করেছে। দেখতে ভাল, বংশ ভাল, বিশেষ কোন দাবিদাওয়া নেই, তাই এই প্রস্তাব মা হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। এমন অভিভাবকহীন টানাপোড়েনের সংসারে এমন ভাল পাত্র সবসময় জুটবেনা, এটা শুধু মা নয়, বোঝার মত বয়স আমারও হয়েছে।
পরীক্ষা শেষ হতেই বিয়ের তারিখ পড়ল, আমরা গোছানোর জন্য মাত্র বাইশ দিন সময় পেলাম, একটা বিয়ের আয়োজনে এ সময় খুবই কম, তাই সাহায্য করবার জন্য আমাদের দুজন মামাকে খবর দেয়া হল।
ঘরবাড়িতে পারিপাট্য এবং সৌন্দর্যবধর্নের দায়িত্বটা আমাকেই হাতে নিতে হল। সারাদিন ব্যস্ততার মাঝেও কখনও কখনও চোখ আটকে যেত ইতুর দিকে, সুখী সুখী একটা ভাব নিয়ে তার বাড়ীময় ঘুরে বেড়ানোটা খেয়াল করতাম আমি।
বাইশ দিন প্রায় ফুরিয়ে এল, আমরা সবাই মিলে সাধ্য অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করলাম।
১৩ই ফাল্গুণ, সকাল থেকেই বিয়ের সাজসাজ রব পুরো বাড়ীতে। ছেলে বাড়ী থেকে তত্ত্ব পাঠানো হল দুটো সুটকেসে। সুটকেস খুলে সবাই ছোটখাট একটা ধাক্কা খেলাম ! দুটো সুটকেস উপচে পড়ছে শাড়ী, কসমেটিকস আর গয়নায় ! পাড়া প্রতিবেশীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল দেখার জন্য। কেউ কেউ আবার মন্তব্য করছিল ‘রাজকপাল ইতুর !’ নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে এলাম ভীড়ের মধ্য থেকে। আশ্চর্য এক মন খারাপে আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম প্রচন্ডভাবে, সত্যিই তো, ইতুর রাজ কপালই বটে! নিজের ঘরে চুপচাপ বসে রইলাম আমি।
“এমন মন মরা হয়ে বসে আছিস কেন !”
মায়ের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম, অপ্রত্যাশিত এই আদরটুকু আপ্লূত করল আমাকে। মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ, নিঃশব্দে। নিরবতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, বোধ আছে, সেই বোধ জানান দিচ্ছিল জড়িয়ে রাখা অপর মানুষটিও আবেগাক্রান্ত। সে আবেগ বহু অলিগলি পার হয়ে আমার স্রোতধারাতেই মিশেছে।
দীর্ঘসময় পর আমি উঠে দাঁড়ালাম , হাসিমুখে বললাম, “একমাত্র বোনের বিয়েতে আমাকে একটা শাড়ী কিনে দিলেনা মা !”
মা হাসলেন বললেন—“আমার আসমানী রঙের শাড়ীটা পড় না ! তোকে অনেক সুন্দর লাগে।“
গোসল সেরে অনেক সময় নিয়ে তৈরী হলাম আমি, সাজলাম! চোখে কাজল পড়লাম, হাত ভর্তি করে চুড়ি পড়লাম , ছোট্ট একটা টিপও পড়লাম কপালে!
মা এসে অনেক যত্ন করে একজোড়া ঝুমকো পড়িয়ে দিলেন তার, চোখভর্তি পানি নিয়ে কপালে চুমু দিলেন, বুকে জড়িয়ে রাখলেন অনেক্ষণ।
ইতুর ঘরে পৌছলাম যখন, তখন ওর সাজগোজ হয়ে গেছে প্রায়, ওর বান্ধবীরাই মোটামুটি শেষ করে ফেলেছে এসব। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না ! কি যে সুন্দর লাগছিল ইতুকে !
একে একে সমস্ত আয়োজন শেষ করার পর যখন ছেলেপক্ষ ইতুকে নিয়ে রওনা হল তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায়। শেষ মুহুর্তে দাদী আর মাকে সামলানো যাচ্ছিলনা! এমন আবেগ ঘন মুহুর্তে তাই বাধ্য হয়ে শক্ত হতে হল আমাকে, বোনকে বিদায় জানানোর কষ্ট ছাপিয়ে আশ্চর্যভাবে অভিভাবকের রুপটা চলে এল অজান্তেই !
ওরা চলে যাবার পর দাদীকে শুইয়ে দিলাম বিছানায়, এই বয়সে কান্নার ধকলটা ঠিক নিতে পারেনি তার শরীর। মা নিজে থেকেই শোবার ঘরে গেলেন, কাঁদছিলেন তখনও।
সন্ধ্যার আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, তাও রাহিলা বু দরজা জানালাগুলো বন্ধ করেনি, আলো জ্বালায়নি ঘরে। বুঝলাম, নিজের সন্তান না হলেও কোলেপিঠে করে বড় করা মেয়েটার বিচ্ছেদে শোকাচ্ছন্ন সেও ! তাই আলো জ্বালিয়ে আমিই পা বাড়ালাম অসম্পূর্ণ কাজ গুলো সম্পন্ন করতে। সিঁড়ি থেকে দুপা নেমেই থমকে দাঁড়ালাম ! আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। উঠোনে অস্পষ্ট আলোয় একটা ছায়ামূর্তী দেখতে পেলাম। প্রচন্ড ভয়ে আমার শরীর জমে গেল, আটকে গেল গলার স্বর ! প্রাণপন চেষ্টা করলাম চিৎকার দেবার, কিন্তু পারলাম না।
ছায়ামূর্তী ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো কাছে, “তুমি নীতু, তাইনা ?”
আমি অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম মানুষটির দিকে।
“কি অদ্ভুত সুন্দর তুমি ! আলো হাতে কেমন মায়াবিনীর মত লাগছে তোমাকে ! একটু ছুঁয়ে দেখি?”
আমার বাকশক্তি স্তব্ধ হল, চোখ বেয়ে অবিরাম নামতে লাগল জলধারা ! অনেক কষ্ট করে শুধু একটা লাইন উচ্চারণ করতে পারলাম--- “বাড়ী খুঁজে পেলে কেমন করে ইফতেখার ?”