Connect Flights

Connect Flights Traveling anywhere soon or later, book your desired flight at the Best Rate only from

18/12/2024
আমার বোন ইতু আমার চেয়ে ছয় মিনিট একত্রিশ সেকেন্ডের ছোট। পুরো পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমাদের জন্ম। মা সন্তান সম্ভাবা ...
26/02/2024

আমার বোন ইতু আমার চেয়ে ছয় মিনিট একত্রিশ সেকেন্ডের ছোট। পুরো পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমাদের জন্ম। মা সন্তান সম্ভাবা হবার পর দাদিজানের বদ্ধমূল ধারনা ছিল ছেলে হবে, কিন্তু তাকে হতাশ আর আশাহত করে আমরা দুবোন পৃথিবীতে এলাম।

পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও গুঞ্জন, প্রথমেই মাইয়া হইল ! তাও আবার দুইডা ! দাদীজান এসব মন্তব্য শুনে আরও বেশী উস্কে থাকতেন ! মায়ের প্রতি অহেতুক অসন্তুষ্টি দেখানোর ক্ষেত্রে একটা নতুন মাত্রা যোগ হল যেন। কপালে বিরক্তির ছাপ নিয়ে সামনের খোলা বারান্দার চকিটাতে পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন সারাক্ষণ। আমরা দুবোন যখন খিদেয় তার স্বরে চিৎকার করতাম, তার কপালে ভাঁজের সংখ্যা দ্বিগুণ হোত। খেদ নিয়ে বলতেন—“দুই মাইয়া তো ওসমানরে পথের ফকির বানায়ে দিব ! এত্ত খিদা লাগে ক্যান এগো !”

আমার মা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন এসব শুনে, প্রতিউত্তর করার স্বভাব কখনওই ছিলনা তার।

আমার বাবা সৈয়দ ওসমান সিরাজ পেশায় পোস্ট মাষ্টার ছিলেন। খুব হাসিখুশি, প্রাণখোলা একজন মানুষ। মেয়ে হবার কারনে তিনি অসন্তুষ্ট বা বিচলিত ছিলেন না একদমই। আমাদের দুবোনকে একসাথেই কোলে নিতেন, ছড়া কেটে কেটে আদর করতেন ঘুম পাড়াতেন।

মাকে ঘরের কাজে, আমাদের লালন পালনে সাহায্য করত রাহিলা বু। মূলত তার কাছ থেকেই আমাদের জন্মের পরের ঘটনা গুলো শোনা। আমাদের দুবোনকে অনেক আদর করতেন উনি।

জমজ হলেও আমাদের দুবোন দেখতে একেবারেই ভিন্ন ছিলাম, কোন মিল ছিলনা চেহারায়। ইতুটার গায়ের রঙ ছিল টকটকে ফর্সা, খাড়া নাক, টানা চোখ ! পাশাপাশি আমার গায়ের রঙ ছিল শ্যামবর্ণের, জাপানিদের মত বোঁচা নাক ! সবাই খুব অবাক হত, পাশের বাড়ীর মালতী মাসীতো দেখলেই বলত –‘নীতুর চেহারা কার মত হইল বলেন তো খালা ! একদম আলাগ !’

এসব কথায় মায়ের ফর্সা মুখে লাল আভা দেখা দিত রাগে, বাসন কোসন থালাবাটির ঝনঝন শব্দে তার বহিঃপ্রকাশ হতো। আর দাদীজানের জমানো জেদ উগড়ে বেরিয়ে আসত, হাহুতাশ করে মালতী মাসীর সাথে গলা মেলাতেন তিনি।

বড় হবার সাথে সাথে আমাদের দুজনের লালল পালনে বেশ কিছু পার্থক্য এল, যেমন—আমাকে প্রতিদিন কাঁচা হলুদ আর দুধের সর মাখিয়ে আধা ঘন্টা বসিয়ে রাখা হত , সরিষার তেল লাগিয়ে নাক টেনে খাড়া করার প্রচেষ্টা চলত দুবেলা ! ইতুর বেলায় এসবের দরকারই পড়ত না। আমার হলুদ মেখে বসে থাকার সময়টায় ইতু পুরো উঠোন দাপিয়ে বেড়াতো।কখনও হাঁসের পেছনে, কখনও ছাগলছানার সাথে দৌড়ে। আ্মি জলচকিতে বসে চুপচাপ দেখতাম ওকে।

কাপড়চোপড় কেনার বেলাতেও ঝামেলা হতে লাগল। ইতুর গায়ে যে কোন রঙের ফ্রক অনায়াসেই মানিয়ে যেত , আর আমার বেলায় যত বাছাবাছি, নির্ধারিত কিছু রঙ ছিল আমার জন্য! হালকা গোলাপি, কুসুম হলুদ কিংবা আকাশী !

একটু বড় হবার পর থেকেই বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করলাম আমি, এবং খুব চেষ্টা করতাম মন খারাপ না করে পরিস্থিতি গুলো মেনে নিতে। বেশ ছোট বয়স থেকেই খাপ খাওয়ানোর অভ্যেসটা রপ্ত হয়ে গেল আমার।

এরমধ্যে আমাদের পরিবারে নেমে এল অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ! বাবা মারা গেলেন। সুস্থ মানুষটা গল্প করতে করতে রাতের খাবার খেলেন। পান চিবোতে চিবোতে দাদীজানের সাথে খানিক্ষণ গল্প করে চলে গেলেন শোবার ঘরে। তার পরপরই মাকে ডেকে বললেন—“খুব হাঁসফাঁস লাগতেছে ! খাওয়া বেশি হয়ে গেছে মনে হয় ! কি করি কওতো !”

মা দৌড়ে রান্না ঘরে গেলেন, লেবু কচলে পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখলেন, বাবার নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। মায়ের চিৎকারে সবাই ছুটে এলাম, ডাক্তার চাচাকে ডেকে নিয়ে এল তখনই পাশের বাড়ীর মন্টু। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ ! বাবা চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে।

বাবার এই হঠাৎ মৃত্যুতে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। দাদীজান একদম ভেঙে পড়লেন, সারাক্ষণ খোলা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন আর থেকে থেকে আর্তনাদ করতেন। মা খুব চুপচাপ হয়ে গেলেন, এই শোকের ধকল কাটাতে অনেক সময় লেগে গেল তার, আর ততদিনে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে কেমন বুড়িয়ে গেলেন মা!

২.
সময়্তো বয়ে চলে তার আপন গতিতে ! আমরা দুবোন বড় হতে লাগলাম একটু একটু করে। হাইস্কুলের গন্ডি পার হয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। ইতুটা দিন দিন ভয়াবহ সুন্দরী হয়ে উঠছিল। আমরা যখন কলেজে যেতাম অগণিত মুগ্ধ চোখ স্থির হতো ওর দিকে, পাড়ার ছেলেগুলো কেমন হা করে তাকিয়ে থাকতো ! ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস টের পেতাম আমি, সেটা গোপন করে হাসতাম আপন মনেই, ভাবতাম- আমারইতো বোন ! তবুও কেন এই অদ্ভুত মন খারাপে আচ্ছন্ন হই বারবার !

মুগ্ধতার এই ব্যাপারটা ইতু নিজেও বেশ ভালই বুঝতে পারত, ওর চোখে প্রচ্ছন্ন একটা পরিতৃপ্তি স্পষ্ট দেখতে পেতাম আমি। আচরণেও কেমন অহংকারী আর বেপরোয়া একটা ভাব ফুটে উঠত, শান্ত আর চুপচাপ থাকা আমি ওর এমন বহিঃপ্রকাশে যেন আরও সংকুচিত হতাম, হীনমন্যতায় গুটিয়ে যেতাম প্রতিনিয়ত।

মাঝে মাঝে নিজেকে দাড় করাতাম আয়নার সামনে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম নীতুকে! পিঠে ছড়িয়ে থাকা লম্বা চুলে,চোখের মায়ায় কিংবা ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটায় যেটুকু স্নিগ্ধতা খুঁজে পেত মন, সেটা বড় নগন্য! ইতুর ঝলমলে দ্যুতি ছড়ানো সৌন্দর্যের কাছে তা ম্লান হয়ে যেত তখনই! অজানা অভিমানে চোখ ভিজে উঠত বারবার, আমার মন খারাপের আকাশ আরও ভারী হত নিকষ কালো মেঘে!

এ বয়সেই অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসছিল ইতুর। পড়াশোনায় যেহেতু বরাবরই অমনযোগী ছিল, তাই দাদীজান সামনের চকিটায় পা ছড়িয়ে বসে বসে প্রায়ই বলতেন—“পড়াশোনা বেশী দূর হইবনা ওরে দিয়া ! বিয়ার জোবা লাগছে যেহেতু, বিয়া দিতাছো না ক্যান মাইয়াডারে ! রুপ দেইখা পাগল হইছে মাইন্সে, সুযোগ কামে লাগাও বউ !"

মা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন ইতুর দিকে, সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ইতু কাঁচা আম বা তেতুল ভর্তার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত।


না চাইলেও ইতু আর আমার পৃথিবী আলাদা হতে লাগল একটু একটু করে। আমাদের মনন স্বভাব আচরণের তফাৎ গুলো দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালো আপনা থেকেই। যে সময়টা ইতু রুপচর্চা, সাজসজ্জা, আর বান্ধবীদের নিয়ে গল্পে আনন্দে পার করত, সে সময়টায় আমি প্রশান্তি খুঁজতাম লাইব্রেরী থেকে আনা গল্পের বই আর মালতী মাসীর কাছ থেকে ধার করে আনা পত্রিকা, ম্যাগাজিন গুলোতে, তৈরী করে নিয়েছিলাম আপন ভুবন।

ম্যাগাজিন গুলোর শেষ পাতায় প্রায়ই ছোট ছোট বিজ্ঞাপন খুঁজে পেতাম—বন্ধু চাই, পত্রমিতালী করতে চাই। দারুণ আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞাপন গুলো পড়তাম। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত কোন এক ঠিকানায় দুলাইন চিঠি লিখে পাঠাই। কিন্তু সাহস করে হয়ে উঠত না। কোথাকার কে, ভাল না মন্দ, এসব ঠিকানা আদৌ সত্যি কিনা এমন হাজারও ভাবনা দ্বিধা-দ্বন্দে শেষ পর্যন্ত আর লেখা হতো না।

ইফতেখার আহমেদ, বয়সঃ ২৭ , জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঠিকানাটা মাথার মধ্যে কেমন করে আটকে গেল ! সারাক্ষনই ঘুরতে লাগল মাথার ভেতর ভাঙ্গা রেকর্ডের মত। হঠাৎ একদিন লিখে ফেললাম দুলাইন ! চুপিচুপি পোষ্ট অফিসে গিয়ে পোষ্টও করে ফেললাম। আমার হাতপা কাঁপছিল রীতিমত।

তারপর অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে শুরু করল প্রতি মুহুর্তে ! যদি সত্যি সত্যি উত্তর আসে ! কি করব তখন ! উৎকণ্ঠায় কাটতে লাগল দিন, তারপর সপ্তাহ। কিন্তু উওর এলোনা, আমার অপেক্ষায় ভাটা পড়ল। একসময় ভুলে গেলাম, মাথা থেকে মিলিয়ে গেল বিষয়টা।

৩.
সামনে পরীক্ষা, মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পুরোপুরি মনযোগী হলাম পড়াশোনায়। বরাবরের রেজাল্ট ধরে রাখাটা অনেক জরুরী আমার জন্য। ঠিক সতের দিনের মাথায় ডাকপিয়ন চাচার গলার আওয়াজ শুনে দৌড়ে বের হলাম ঘর থেকে, আমাকে দেখেই হাঁক দিলেন—“নীতু মা ! তোমার নামে একখান চিঠি আইছে ঢাকা দিয়া !”

আমি তড়িঘড়ি করে চিঠিটা হাতে নিয়েই ছুটে ঘরে গেলাম, লুকিয়ে রাখলাম বইয়ের ভাঁজে। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল তেষ্টায়। চিঠিটা খুলেছিলাম গভীর রাতে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছোট্ট চিঠিটা কতবার যে পড়েছিলাম!
সেই থেকে শুরু ! সময়ের সাথে সাথে একের পর এক খামে আমার ভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন পৌঁছে যেতে লাগল অজানা অচেনা এক শহরে। দিনের পর দিন শুধু লিখেই যাচ্ছিলাম গভীর আগ্রহে, ভাললাগায়। একটা সময় ইফতেখার আর অজানা কেউ রইলনা, মনের সাথে প্রগাঢ় জানশোনার এই মানুষটাকে যেন আমি দেখতে পেতাম ! অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তী আমার কল্পনা জগতে বিচরণ করত সারাক্ষণ।

ন’মাসের মাথায় যে চিঠিটা এল, সেই চিঠির ভাঁজে একটা ছবি পেলাম ইফতেখারের, কি স্নিগ্ধ মায়ামাখা একটা মুখ ! ছোট্ট চিঠিটায় লেখা -----

প্রিয় নীতু,

ভালবাসা জেনো, আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে, পাশ করেছি। পার্ট টাইম একটা চাকরীও পেয়েছি জানো ! আপাতত খারাপ না ! তোমাকে কবে দেখবো বলোতো ! একটা ছবি অন্তত পাঠাতে পারো ! এবার চিঠির সাথে একটা ছবি চাই, দেবে তো ? অপেক্ষায় রইলাম।
, “ ইফতেখার”

আমি গভীর সঙ্কটে পড়লাম। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছিল। আমার চিঠি পড়ে ইফতেখার যতটা মুগ্ধ, আমার ভাবনা স্বপ্নের কথা জেনে যতটা বিমোহিত, চোখের দেখায় সে ঘোর কেটে যাবে নিমিষেই। আমি নিশ্চিত তার কল্পনার নীতু আর বাস্তবতার নীতুর ব্যবধান তাকে আশাহত করবে প্রচন্ডভাবে। আর সেটা অনেক বড় অপমানের , লজ্জার !

অনেক কাঁদলাম আমি, অনেক। তারপর শান্ত হলাম, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম—আজ থেকে আর চিঠি লিখবনা ইফতেখারকে, এটাই একমাত্র উপায়। বন্ধ করে দিলাম যোগাযোগ ! খাটের নীচের পুরানো ট্রাংকে তালা বন্ধ করে দিলাম চিঠিগুলো। যে মানুষটাকে চোখে দেখিনি, কথা হয়নি কখনও তার জন্য হাহাকারে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল ! কি অদ্ভুত ভাবে গভীর ক্ষত তৈরী হল মনে , রাত জেগে তার দগদগে যন্ত্রণা টের পেতাম আমি।

৪.
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হল আমাদের। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দিন রাত পড়াশোনা, প্রস্তুতি, আর পরীক্ষা ! এর মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হল ইতুর বিয়ে ! পরীক্ষার মধ্যেই এসে ছেলেপক্ষ ইতুকে আংটি পড়িয়ে গেল, সিদ্ধান্ত নেয়া হল পরীক্ষা শেষ হলে ভাল দিনক্ষণ দেখে বিয়ের আয়োজন করা হবে।

পাত্র আমাদের কলেজেই ইংরেজী পড়ায়, ইতুকে দেখে খুব পছন্দ করেছে। দেখতে ভাল, বংশ ভাল, বিশেষ কোন দাবিদাওয়া নেই, তাই এই প্রস্তাব মা হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। এমন অভিভাবকহীন টানাপোড়েনের সংসারে এমন ভাল পাত্র সবসময় জুটবেনা, এটা শুধু মা নয়, বোঝার মত বয়স আমারও হয়েছে।

পরীক্ষা শেষ হতেই বিয়ের তারিখ পড়ল, আমরা গোছানোর জন্য মাত্র বাইশ দিন সময় পেলাম, একটা বিয়ের আয়োজনে এ সময় খুবই কম, তাই সাহায্য করবার জন্য আমাদের দুজন মামাকে খবর দেয়া হল।

ঘরবাড়িতে পারিপাট্য এবং সৌন্দর্যবধর্নের দায়িত্বটা আমাকেই হাতে নিতে হল। সারাদিন ব্যস্ততার মাঝেও কখনও কখনও চোখ আটকে যেত ইতুর দিকে, সুখী সুখী একটা ভাব নিয়ে তার বাড়ীময় ঘুরে বেড়ানোটা খেয়াল করতাম আমি।

বাইশ দিন প্রায় ফুরিয়ে এল, আমরা সবাই মিলে সাধ্য অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করলাম।

১৩ই ফাল্গুণ, সকাল থেকেই বিয়ের সাজসাজ রব পুরো বাড়ীতে। ছেলে বাড়ী থেকে তত্ত্ব পাঠানো হল দুটো সুটকেসে। সুটকেস খুলে সবাই ছোটখাট একটা ধাক্কা খেলাম ! দুটো সুটকেস উপচে পড়ছে শাড়ী, কসমেটিকস আর গয়নায় ! পাড়া প্রতিবেশীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল দেখার জন্য। কেউ কেউ আবার মন্তব্য করছিল ‘রাজকপাল ইতুর !’ নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে এলাম ভীড়ের মধ্য থেকে। আশ্চর্য এক মন খারাপে আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম প্রচন্ডভাবে, সত্যিই তো, ইতুর রাজ কপালই বটে! নিজের ঘরে চুপচাপ বসে রইলাম আমি।

“এমন মন মরা হয়ে বসে আছিস কেন !”

মায়ের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম, অপ্রত্যাশিত এই আদরটুকু আপ্লূত করল আমাকে। মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ, নিঃশব্দে। নিরবতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, বোধ আছে, সেই বোধ জানান দিচ্ছিল জড়িয়ে রাখা অপর মানুষটিও আবেগাক্রান্ত। সে আবেগ বহু অলিগলি পার হয়ে আমার স্রোতধারাতেই মিশেছে।

দীর্ঘসময় পর আমি উঠে দাঁড়ালাম , হাসিমুখে বললাম, “একমাত্র বোনের বিয়েতে আমাকে একটা শাড়ী কিনে দিলেনা মা !”

মা হাসলেন বললেন—“আমার আসমানী রঙের শাড়ীটা পড় না ! তোকে অনেক সুন্দর লাগে।“

গোসল সেরে অনেক সময় নিয়ে তৈরী হলাম আমি, সাজলাম! চোখে কাজল পড়লাম, হাত ভর্তি করে চুড়ি পড়লাম , ছোট্ট একটা টিপও পড়লাম কপালে!

মা এসে অনেক যত্ন করে একজোড়া ঝুমকো পড়িয়ে দিলেন তার, চোখভর্তি পানি নিয়ে কপালে চুমু দিলেন, বুকে জড়িয়ে রাখলেন অনেক্ষণ।

ইতুর ঘরে পৌছলাম যখন, তখন ওর সাজগোজ হয়ে গেছে প্রায়, ওর বান্ধবীরাই মোটামুটি শেষ করে ফেলেছে এসব। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না ! কি যে সুন্দর লাগছিল ইতুকে !

একে একে সমস্ত আয়োজন শেষ করার পর যখন ছেলেপক্ষ ইতুকে নিয়ে রওনা হল তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায়। শেষ মুহুর্তে দাদী আর মাকে সামলানো যাচ্ছিলনা! এমন আবেগ ঘন মুহুর্তে তাই বাধ্য হয়ে শক্ত হতে হল আমাকে, বোনকে বিদায় জানানোর কষ্ট ছাপিয়ে আশ্চর্যভাবে অভিভাবকের রুপটা চলে এল অজান্তেই !

ওরা চলে যাবার পর দাদীকে শুইয়ে দিলাম বিছানায়, এই বয়সে কান্নার ধকলটা ঠিক নিতে পারেনি তার শরীর। মা নিজে থেকেই শোবার ঘরে গেলেন, কাঁদছিলেন তখনও।

সন্ধ্যার আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, তাও রাহিলা বু দরজা জানালাগুলো বন্ধ করেনি, আলো জ্বালায়নি ঘরে। বুঝলাম, নিজের সন্তান না হলেও কোলেপিঠে করে বড় করা মেয়েটার বিচ্ছেদে শোকাচ্ছন্ন সেও ! তাই আলো জ্বালিয়ে আমিই পা বাড়ালাম অসম্পূর্ণ কাজ গুলো সম্পন্ন করতে। সিঁড়ি থেকে দুপা নেমেই থমকে দাঁড়ালাম ! আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। উঠোনে অস্পষ্ট আলোয় একটা ছায়ামূর্তী দেখতে পেলাম। প্রচন্ড ভয়ে আমার শরীর জমে গেল, আটকে গেল গলার স্বর ! প্রাণপন চেষ্টা করলাম চিৎকার দেবার, কিন্তু পারলাম না।

ছায়ামূর্তী ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো কাছে, “তুমি নীতু, তাইনা ?”

আমি অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম মানুষটির দিকে।

“কি অদ্ভুত সুন্দর তুমি ! আলো হাতে কেমন মায়াবিনীর মত লাগছে তোমাকে ! একটু ছুঁয়ে দেখি?”

আমার বাকশক্তি স্তব্ধ হল, চোখ বেয়ে অবিরাম নামতে লাগল জলধারা ! অনেক কষ্ট করে শুধু একটা লাইন উচ্চারণ করতে পারলাম--- “বাড়ী খুঁজে পেলে কেমন করে ইফতেখার ?”

একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, অতিথি রুমে আলো জ্বলছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলি,- 'কে এসেছে, আলো জ্বলছে যে ঐ ঘরে।'আমা...
24/02/2024

একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, অতিথি রুমে আলো জ্বলছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলি,

- 'কে এসেছে, আলো জ্বলছে যে ঐ ঘরে।'

আমার স্ত্রী বলে,
- 'তোমার দেশের বাড়ি থেকে দুজন মানুষ এসেছে। সম্ভবত ওনারা স্বামী স্ত্রী।'

- 'তাই। তুমি কী ওনাদের আগে দেখনি?'

- 'না। মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমি তোমার কী হই?’ আমি যখন বলি, ‘আমি তোমার স্ত্রী হই।’ তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি আমাদের রঞ্জনের বউ! ও মা, কত সুন্দর তুমি!’ তারপর আমাকে যত সব আদর করা শুরু করেছিল।'

আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই অতিথি রুমে যাই। দেখি, পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা ও একজন পুরুষ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার মুখ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ওঠে। ওনারও আমাকে চিনতে পারছিল না।

আমার স্ত্রী মহিলাকে বলে,
- 'ইনি হচ্ছেন আপনাদের রঞ্জন, আপনাদের ছেলে।'

মহিলা আমার পরিচয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে এবং বলে,

- 'তুমি এত বড় হয়ে গেছ!'

মহিলা বলেন,
- 'তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। সেই ছোট বেলায় আমাকে দেখেছ। আমি তোমার ‘জহুরা বুবু’ , মনে পড়ছে আমার কথা? মনে পড়ে কী আমাকে? সেই কত বছর আগের কথা।'

----
------------

পঁচিশ বছর আগে,

ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। স্কুল থেকে বাড়িতে
ফিরলে আমাকে খেতে দিতো হয় মা, না হয় জহুরা বুবু। জহুরা বুবু আমার জন্মের আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল। সেই নাকি কোলে পিঠে আমাকে লালন পালন করেছে। আমাকে দেখে শুনে রেখেছে।

একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, জোহরা বুবু চোখে মোটা করে কাজল পরে আছে। আমি তার চোখের দিকে বিস্ময়ে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকি।

জহুরা বুবু আমাকে বলে,
- 'কী দেখছ তুমি?'

আমি আঙুল দিয়ে জহুরা বুবুর চোখ দুটো দেখাই।

জহুরা বুবু বলে ওঠে,
- 'ওরে আমার ভাইটা।'

বলেই তার চোখ থেকে আঙ্গুল দিয়ে কাজল মুছে মুছে আমার চোখে পরিয়ে দেয়। জহুরা বুবুর দেওয়া তার চোখের কাজল আমার চোখে এখন আর নেই। তা মুছে গেছে কবে।

একদিনের কথা মনে আছে। আমার খুব জ্বর এসেছিল। দু-তিন দিনেও জ্বর নামছিল না। এই জহুরা বুবু মাকে কিছুতেই রাত জাগতে দেয়নি। সেই একটানা চার রাত আমার সিয়রে বসে জেগে থেকেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। দুচোখের পাতা একটু সময়ের জন্য সে বন্ধ করেনি।

আমার শিশুকালে জহুরা বুবু কতো যে সেবা যত্ন করেছে, কত যে বিরক্তি ও যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে সব কথা আমার মনে নেই। আমি শুধু আমার মার কাছে থেকে সে সব কথা পরে শুনেছি।

আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, এক বর্ষার দিনে জহুরা বুবুর বিয়ে হয়ে যায়। মা বাবাই সমস্ত বন্দোবস্ত করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় দূরের এক গ্রামে। আমার শুধু মনে আছে, শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় জহুরা বুবু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ফূঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নৌকায় উঠে সারা পথ নাকি সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল।

বিয়ে হয়ে যাবার পর জহুরা বুবু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত। তারপর তার সংসার ব্যস্ততায় খুব বেশি আসত না। তারপর একদম না। তারপর চলে গেছে অনেক বছর। জহুরা বুবু আস্তে আস্তে সবার কাছে বিস্মৃত হয়ে যায়।


এই বিস্মৃত জহুরা বুবু কে দেখে যতটুকু খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি বিষাদে মনটি ভরে উঠল। জহুরা বুবু কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। মনে হল, সে বড় ধরণের কোনো রোগে দুঃখে ভুগছে।

জহুরা বুবুই বলছিল,
- 'আমি তোমাদের বাড়ি থেকে ঠিকানা নিয়ে তোমার এখানে এসেছি। আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে মনে হয়। ওখানে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই অসহায় হয়ে তোমার এখানে চলে এলাম। এই ঢাকা শহরে আমাদের আপন কেউ নেই। তোমার কথা মনে হল। তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।'

আমি জহুরা বুবু কে বলি,
- 'তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখাবো। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবে।'

জহুরা বুবু কিছু টাকা বের করে আমার হাতে দেয়। বলে,

- 'জানি না, কত খরচ হবে। তুমি এখান থেকে খরচ করবে।'

আমি ঐ মুহুর্তে জহুরা বুবু কে কোনো করুণা করতে চাইনি। আমি তার হাত থেকে টাকা নিয়ে নেই।

রুমে এসে আমি আমার স্ত্রীকে বলি,
- 'জানি, তোমাকে না বললেও তুমি ওনাদের জন্য অনেক করবে। তবুও বলছি, তুমি বিরক্ত হবে না।'

তোমাকে একটা কথা বলি,
- 'এই জহুরা বুবু আমার বড় বোনের মতন, আমার মায়ের মতন। আমার সর্ব শরীরে ওনার মায়া, মমতা, আদর স্নেহ লেগে আছে।'

আমার ছলো ছলো চোখ দেখে, ও শুধু বললো,
- 'ওনাদের কোনও অসম্মান ও অবহেলা হবে না। তুমি দেখ।'


শহরের সবচেয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জহুরা বুবু কে দেখাই। ওনার সমস্ত কিছু চেক আপ করানো হয়। সব গুলো রিপোর্ট পেতে দুই তিন লেগে যায়। ইতোমধ্যে ঔষধ ও খেতে থাকে। সুন্দর চিকিৎসা পেয়ে জহুরা বুবুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

একদিন রাতে টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, আমার খাওয়া দেখে জহুরা বুবু আমার স্ত্রীকে বলছিলো,

- 'বউ মা, তুমি রঞ্জনকে এত ঝাল ভাত খাওয়াও কেন? ও তো ছোটবেলায় ঝালভাত খেত না। দুধ আর সর্বিকলা দিয়ে ভাত খেত। ও কোনো সময় নিজ হাত দিয়ে ভাত খেত না। চাচি আম্মা, না হয়‌ আমি তুলে খাওয়াতাম।'

আর একদিন আমার মাথার চুলে তেল নাই দেখে, আমার স্ত্রীকে বলছিলো,

- 'বউ মা, তুমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দাও না কেন? সরিষার তেল নিয়ে আসো, আমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দেই।'

এ রকম আরও অনেক কিছু ঐ অল্প কয়দিনে আমাকে পেতে হয়েছে।

ইতোমধ্যে সমস্ত রিপোর্ট গুলো পেয়ে যাই। জহুরা বুবু কে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট সব দেখলেন। রিপোর্ট দেখে তাঁর মুখটি বিমর্ষ হয়ে উঠে। তিনি নতুন করে আরও ঔষুধ দিলেন। এবং ইংরেজিতে আমাকে বললেন, ‘'আপনি ওনাদের বাইরে রেখে এসে আমার সাথে দেখা করুন।’ আমি জহুরা বুবুকে বাইরে রেখে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করি।

ডাক্তার বললেন, ‘ওনার লিউকেমিয়া ধরা পড়েছে। রক্তের ক্যান্সার। খুব বেশি হলে উনি তিন মাস বাঁচতে পারে। এই চিকিৎসা এখানে এখনও ঐ রকম নেই। খুব ব্যায়বহুল। আর করেও লাভ হবে না।’

জহুরা বুবু তার স্বামীসহ আমার বাসায় আরো তিন দিন ছিল। আমি জহুরা বুবুকে বলি,

- 'ডাক্তার সাহেব তোমাকে তিন মাসের ঔষধ দিয়ে দিয়েছে। তুমি যদি ভালো না হও, তিন মাস পর আবার এসো।'


যেদিন জহুরা বুবু চলে যাবে, সেদিন বুবুকে বলি,
- 'বুবু তুমি আমার চোখে একটু কাজল পরিয়ে দাও না!'

আমার স্ত্রীর কাছে কাজল ছিলো। সপ কাজল নিয়ে আসে। জহুরা বুবু আমার চোখে কাজল পরিয়ে দেয়। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। দেখি, জহুরা বুবু অঝোরে কাঁদছে।

তারপর আরও কত বছর চলে গেছে। শুনেছি অনেক আগেই জহুরা বুবু চলে গিয়েছেন জীবন নদীর ওপারে। তার দেওয়া সেই কাজল এখন আর আমার চোখে নেই। তা কবে মুছে গিয়েছে!

(সমাপ্ত)...

#ছোটগল্প
তার_দেওয়া_কাজল
কোয়েল_তালুকদার
----
গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন। আর কমেন্টে আপনার মূল্যবান মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।

18/03/2022
18/03/2022

Address

Dhaka
1229

Telephone

+8801723036462

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Connect Flights posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category