27/12/2023
তার নাম রাম চরণ। কে এই লোক? পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের রুমে বিনা এপয়েন্টমেন্ট ঢুকে যেতে পারেন এই লোক। তাতে টেবিলের ওপাশে বসা লোকটি বরং ধন্যই হয়ে যান। কে এই রাম চরণ?
একবার বিখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিলো যেখানে বিশাল কলেবরে জোড়া পাতায় একটা আস্ত পৃথিবীর মানচিত্র ছাপিয়ে তার মধ্যে রঙধনুর মতো বাঁকা দাগ কেটে দেখানো হয়েছে গত দুই সপ্তাহ তিনি কোন দিন দুনিয়ার কোথায় ছিলেন। ২০০৭ সালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিলো ‘The Strange Existence of Ram Charan’. সংখ্যাটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। ভেবেছিলাম পুরো সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করবো কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি।
তাঁর প্রসঙ্গে শুধু মজার মজার কয়েকটা কথা বলবো। যতই বলি ততই কম বলা হবে। যে কথাগুলো শুনে দুনিয়ার তাবত মোটিভেশন স্পিকার আর ম্যানেজমেন্ট গুরুরা খাবি খেতে পারেন। কারণ তাদের আওড়ানো তথাকথিত সূত্রগুলো এই মানুষটির ক্ষেত্রে কাজে লাগেনা। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সেরাদের সেরা একজন ব্যবসাবিষয়ক পরামর্শদাতা – বিজনেস কনসাল্ট্যান্ট – যাকে জেনারেল ইলেক্ট্রিক (GE) এর সাবেক সিইও জ্যাক ওয়েলচ একবার বলেছিলেন, আপনাকে এত এত ট্রাভেল করতে হয় একটা প্রাইভেট জেট নিয়ে নিচ্ছেন না কেন? রাম রচণ এই প্রসঙ্গ মাছি তাড়ানো মতো বাতাসে হাত নেড়ে বলেছিলেন, আরে ধূর, এতসব সামলানোর মতো সময় কই? এখন পর্যন্ত একটা গাড়িই হলো না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই বিশ্বখ্যাত ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও পরামর্শদাতার একটা গাড়ি পর্যন্ত নেই। থাকবে কী করে, গাড়ি চালাতে শেখেন নি সারা জীবনে। জিজ্ঞেস করা হলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, গাড়ি কিনে রাখবো কোথায়, রাখার জায়গা তো নেই।
রাম চরণের কাজের কোন সঙ্গী নেই। একা কাজ করেন। কোন অফিস নেই। তার দিন কাটে সারা দুনিয়ার ফাইভ স্টার হোটেলের রুমে থেকে থেকে। না, ভুল বললাম, তার একটা অফিস আছে। আমেরিকার ডালাসে, নর্থ সেন্টার এক্সপ্রেস ওয়েতে। এই ঠিকানাই তার পাসপোর্টে লেখা। রাম চরণ একজন ভারতীয় বংশদ্ভূত আমেরিকান। সেই অফিস সম্পর্কে তিনি তেমন কিছুই জানে না, কারণ সেখানে তিনি কখনো থাকেন না, এমন কি, কখনো যানও না। সেখানে দুই জন ভদ্রমহিলা কর্মরত আছেন যাদের একজনের নাম সিন্থিয়া বার, যিনি রাম রচণের খেপাটে এপয়েন্টমেন্ট শিডিউল ম্যানেজ করতে করেতে হিমশিম খান আর দু’জনে মিলে সপ্তাহে ৩ দিন (সোম, বুধ আর শুক্রবার) রাম চরণের জন্য একটা কার্ডবোর্ড বক্সে পরিস্কার জামা কাপড় প্যাকেট করে নির্ধারিত হোটেলের ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেন। এই কার্ডবোর্ড বক্সের মধ্যে রাম চরণের চরণের জন্যে একজোড়া সাড়ে নয় সাইজের কালি করা জুতা, টুথব্রাশ, টুথপেষ্ট, শেভিং রেজর, শ্যাম্পু, কয়েকটা জামা, খাকি প্যান্ট, জাঙ্গিয়া, গেন্জি ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন, যখন যেটা লাগে। দুই দিন পরে সেই কার্ডবোর্ড বক্সটি ময়লা কাপড় নিয়ে ডালাস অফিসে ফেরত আসে। এই হলো দুই কর্মকর্তার কাজ। ৬ বছর আগে এই দুই কর্মকর্তার ইন্টারভিউ নিয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে তারপর থেকে রাম চরণের সাথে কখনো দেখা হয় নি। আমি পড়ি আর মাথায় হাত দিয়ে ভাবি, এ কেমন মানুষ! আপনিও বলুন, এই মানুষটি সম্পর্কে ফরচুন ম্যাগাজিন ‘রাম চরণের আজব অস্তিত্ব’ শিরোনাম ছাড়া আর কী দিতে পারে। এখনতো বাকি আশ্চর্যের কথা বলাই হয়নি।
এত কিছু শোনার পরে ভাবতে পারেন, কী যোগ্যতা আছে এই মানুষটার যে এমন জীবন যাপন করেও পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ব্যবস্থাপনা গুরুর মর্যাদা পেয়ে বসে আছেন। এই ফরচুন ম্যাগাজিনই তাকে ‘সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ইনফ্লুয়েনশিয়াল জীবন্ত ব্যবসা পরামর্শক’ (Possibley the most influential business consultant alive’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ছোট্ট পরিসরে অনেক কিছু লেখার অবকাশ নেই। শুধু জানিয়ে রাখি, রাম চরণ ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, ভারতেই পড়াশোনা করেছেন। ইচ্ছে ছিলো হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল পড়াশোনা করার। তার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। এবং ফলাফল এতই ভালো ছিলো যে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল তাকে ছাড়েনি। প্রফেসর বানিয়ে রেখে দিয়েছিলো। তার শিক্ষাগত সাফল্যের সব কথা এখানে বলতে গেলে এই লেখা আর ফুরোবে না।
সিটিকর্পের সিইও জন রীড একবার উল্লেখ করেছন, যে মুহুর্তে আপনি ব্যবসার বড় সমস্যার একটা যুতসই সমাধান বের করে এক কাপ কফি নিয়ে আয়েশ করে বসবেন ঠিক তক্ষুণি ভেলিকবাজির মতো রাম চরণের ফোন আসবে। আর আপনাকে সে বুঝিয়ে দেবে, আপনি যা এতক্ষণ ভেবেছেন তার কোন মাথামুন্ডু নেই। আপিন আবার অগাধ জলে ডুবে যাবেন। এই লোকের এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে সঠিক সমস্যাটি খুঁজে বার করার আর আর যুক্তিসংগ্ত সমাধান বার করার।
জেলারেল ইলেক্ট্রিক (GE) এর জ্যাক ওয়েলচ অন্য এক প্রসঙ্গে বলেন, একদিন আমরা বোর্ড রুমে সব পরিচালকরা বসে একটা জটিল সমস্যা সমাধান করার জন্য চুল ছিড়ছিলাম। কোত্থেকে ভূতের মতো দরজা নক করে রাম চরণ বোর্ডরুমে ঢুকে পড়লেন। যদিও দরজা নক না করে সে ঢুকে যেতে পারতেন। দুনিয়ার এমন কোন কোম্পানি নেই যার বোর্ডরুমে রাম রচণ দরজায় টোকা না দিয়ে ঢুকলে কেউ টু শব্দটি করবে। বরং ধন্যই হবে। তো, আমরা সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। যথারীতি বোর্ড রুমে তখন পিন পতন নিরবতা। রাম চরণ সোজা হোয়াইট বোর্ডের কাছ চলে গেলেন এবং এক মনে কী সব লিখতে শুরু করলেন। এভাবে অস্বস্তিকর কয়েক মিনিট কেটে গেলো। কেউ কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছে না, আমিও না। এবং বিশ্বাস করবেন না, রাম চরণ যে সমাধানটি হোয়াইট বোর্ডে লিখলেন আমরা সেই সমস্যাটি নিয়েই এতক্ষণ তর্কবিতর্ক করে যাচ্ছিলাম। রাম চরণ সেটা জানলেন কি করে? এই হচ্ছে তার যোগ্যতার নমুনা। সে তার ক্লায়েন্টের সমস্যা সম্পর্কে এতটাই ভালো জানেন যে ক্লায়েন্ট নিজেও অনেক সময় সেটা জানেন না। আর তার একটা বদ অভ্যাস হচ্ছে, একবার যদি তার পরামর্শে আপনি রাজি হয়ে যান, তারপর দশ মিনিট পর পর সে ফোন করতে থাকবেন - যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি যেটা করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছেন সেটা না করেন।
লতা মঙ্গেশকর রাম চরণের সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী। কিন্তু গান তিনি তেমন একটা শোনেন না, শোনার অবকাশ তিনি পান না। কারণ গান শুনলে তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আর সেটা তার বিজনেস থিংকিংকে এলোমেলো করে দেয়। সুতরাং চিন্তার সময় কোন সঙ্গীত নয়। কিন্তু কোন সময় তিনি বিজনেস থিংকিং করেন না? হ্যাঁ, জীবনে একটা সময় আছে, যখন তিনি ভারতে যান, তাঁর মায়ের সাথে দেখা করেন, নিজ হাতে গরুকে ঘাস খাওয়ান, নিজ হাতে গরুর গোবর দিয়ে মায়ের চুলার জন্য জ্বালানী বানান আর মায়ের সাথে বসে দুধ দিয়ে ভাত খান। তারপর সোজা বিজনেস ক্লাসে ফ্লাই করে চলে আসেন তার কোন বিলিওনিয়ার ক্লায়েন্টের বোর্ড রুমে, হয়ে ওঠেন তাদের গাইডিং স্টার।
যে জীবন তিনি যাপন করতে চেয়েছেন, সারা দুনিয়া যাকে ‘স্ট্রেইন্জ’ বলে আখ্যা দিয়েছে, সেই জীবন সাহস করে যাপন করে যাচ্ছেন। ভালো কথা, জীবনে লক্ষ্য ছাড়া নাকি কিছুই হয় না? মোটিভেশন স্পিকাররা হর হামেশাই বলে থাকেন। রাম রচণকে তার উদ্ভট জবাবে ক্লান্ত এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জীবনের লক্ষ্য কি? তার সোজা উত্তর. আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই। আমি আমার কাজকে ভালোবাসি, এই কাজ আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে সেটাই আমার লক্ষ্য। আমি আগে থেকে কিছু ঠিক করিনা।
এই কথা রাম চরণ বলে পার পেয়ে গেছেন। আপনি আমি বলে পার পাবো না। নজরুল স্কুল পালিয়েছিলেন, তার মানে সব স্কুল পালানো ছেলেই নজরুল হয়নি। ফলে, আপনাকে আমাকে লক্ষ্য অনুসরণ করে চলতে হবে। আমরা লক্ষ্যের কাছে পৌঁছাতে দৌড়াই, আর লক্ষ্য রাম রচণের কাছে পৌঁছানোর জন্য দৌড়ায়। বিশাল ফারাক!
গত ২৫ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন ছিলো। তাঁর বয়স ৮৪ বছর হলো। স্যালুট এই মহান ব্যাক্তিত্বকে।
[সতর্কতা: অনেকের কাছেই রাম চরণের জীবনাচরণ অবিশ্বাস্য লাগা মোটেও অস্বাভাবিক না, দয়াকরে গুগল করলেই আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন। ফরচুন ম্যাগাজিন এর ২০০৭ সালের এপ্রিল সংখার সেই সাক্ষাৎকারটিও অনলাইনে আছে। যাদের আগ্রহ আছে তারা আরো বিস্তারিত জানুন।]