19/05/2025
“রিজিকের অঙ্ক”
-------------------
“লাভ-লোকসানে আটকে থাকা জীবন”:
রুবেল এখন ঢাকায় কর্পোরেট চাকরি করে, মাসিক বেতন ২৭,০০০ টাকা—কিন্তু মাস চলে কেবল ২০ তারিখ পর্যন্ত।এক্সেল শীটে প্রতিবার শেষে ভেসে ওঠে একটি লাল দাগ: “নেট লস” । জীবন মনে হয় শুধু হিসাব আর টেনশনের আরেক নাম।
-----------------------------
”কোরবানি ও আত্মত্যাগের বাস্তব রূপ”:
রুবেল একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরছিল। আসার পথে চোখে পড়ল কোরবানির গরুর একটি বিশাল হাট—চতুর্দিকে ভিড়, হাকডাক, দামাদামি। হঠাৎ ঠিক সেই মুহূর্তে তার মোবাইলে ফোন এল। গ্রামের বাড়ির এক স্কুলবন্ধু ফোন করে বলল, “চল ভাই, সাতজন মিলে একটা মাঝারি গরু নিই।” রুবেলের ভাগ পড়ে ১৫,৭১৪ টাকা। চোখ বন্ধ করে হিসাব করে সে—ঈদের বোনাস ১৩,০০০ টাকা, জমা আছে ২,৭১৪। হিসাব মিলে যায়, হুবহু একদম ঠিকঠাক। তবুও মনে হয়, “না দিলেই বা কী হয়?” কাঁপা হাতে টাকা পাঠিয়ে দেয় বিকাশে।
কিন্তু তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে—মা-বাবার মুখ, ভাইবোনের হাসিমাখা ঈদের সকাল। তখন সে বুঝে যায়, এই কোরবানি শুধু একটি গরুর অংশ নয়—এটা একরকম ভালোবাসার হিসাব।
রুবেল হিসাব কষে বুঝল—এবার আর বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়, যাতায়াতের খরচটাই অনেক বেশি। সেদিনই সে বাড়িতে ফোন করে বাবামাকে মিথ্যে বলে, “এই ঈদে আসতে পারছি না… ঈদের ছুটিতেই অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে ছুটির মধ্যেই।”
---------------------------------------
“ঈদের সকাল: ভালোবাসার রিপোর্ট”:
ঈদের সকালে আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে রুবেলের। চোখ খোলার সাথে সাথেই ফোনটা বেজে ওঠে—স্ক্রিনে ভেসে ওঠে “আম্মু কলিং।” কলটা ধরে সে, আর ওপাশে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসাথে লাউডস্পিকারে বলে ওঠে, “ঈদ মোবারক!” দূরত্ব যেন ফোনের ভেতরেই গলে যায়। রুবেল কিছু বলতে পারে না। গলা ভার হয়ে আসে, চোখের কোণে জমে ওঠে চেপে রাখা জল। দুপুরে তার মেসে খাবার ছিল স্রেফ ভাত, ডিম আর ভাজি। কিন্তু ফোনের ওপাশে যাদের কণ্ঠে ছিল আনন্দ, ভালোবাসা আর অপেক্ষা—তাদের মুখে হাসি ফুটেছে তার ছোট্ট ত্যাগেই। ঈদের সত্যিকারের আনন্দটা যেন এবার নতুন করে বুঝে যায় রুবেল।
-------------------------------------
“অর্থনীতির বড় ছবিতে এক অদৃশ্য হিসাবরক্ষক”:
কোরবানির ঈদ মানে শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক তরঙ্গ। কোরবানির সময় হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়—খামারি, গরু ব্যবসায়ী, কসাই, চামড়া বিক্রেতা, ট্রাকচালক। কিন্তু এই অর্থনীতির মঞ্চের নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকে রুবেলের মতো হাজারো নামহীন মানুষ, যাদের মাসিক আয় প্রায় শেষ হয়ে যায় একটি গরুর এক ভাগেই। তবুও তারা হাসিমুখে দেয়, কারণ এটাই তাদের কাছে ভালোবাসার ইনভেস্টমেন্ট। এই আত্মত্যাগে তৈরি হয় অর্থনীতির প্রাণ, লেখা হয় হৃদয়ের ব্যালেন্স শীটে।
--------------------------------
“রিজিক: বিশ্বাসের এক অদৃশ্য ফাইনান্সিয়াল টুল”:
রুবেল এখন জানে, রিজিক মানে শুধু টাকা নয়—এটা বিশ্বাস।
রিজিক মানে সেই দরজা, যা ঠিক সময়মতো খুলে যায়—যদিও তা এক্সেল শীটে দেখা যায় না।
রুবেল এখন আর আয়-ব্যয়ের খাতায় লাভ খোঁজে না।সে খোঁজে শান্তি, সম্পর্ক, ভালোবাসা আর মানুষের মুখে হাসি। কারণ সে বুঝে গেছে—আসল লাভ দাঁড়ায় তখনই, যখন ত্যাগের অঙ্ক মিলে যায় হৃদয়ের ব্যালেন্স শীটে।
------------------------------------------
“রিজিকের অঙ্ক: সবচেয়ে বড় সম্পদ- বিশ্বাস”:
হয়তো এমনই একজন রুবেলকে নিয়ে কোনো একদিন লিখব—যার চাকরিটা ঈদের ঠিক আগে চলে গেছে, তবু তার হৃদয়ে ঈদের আলো নিভে যায়নি। উনি সম্ভবত এবার ঈদটা ঢাকাতেই কাটাবেন। বাড়ি যাওয়া-আসার খরচটা এখন তার পক্ষে বহন করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। হয়তো এবারের কোরবানিটাও আর দেয়া হবে না তার। সবকিছু মিলিয়ে এবারের ঈদটা হবে একটু নিরব, একটু সংযত।
আল্লাহ, তার ঈদটা যেন শান্তির হয়।দোয়া করি, তার রিজিকের অঙ্ক মিলে যাক আস্থার ব্যালেন্স শীটে।
-------------------------
গল্পকথক:
সৈয়দ নাসিম সৌরভ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএ – ৩৮ ব্যাচ
প্রতিষ্ঠাতা, Sand & Sea – স্যান্ড অ্যান্ড সী
মোবাইল: 01814484486