
01/07/2025
হাওড়া ব্রিজ: কলকাতার গর্ব ও চিহ্ন
হাওড়া ব্রিজ, যা বর্তমানে রবীন্দ্র সেতু নামে পরিচিত, ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক সেতু। এটি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও কলকাতা শহরকে সংযুক্ত করেছে হুগলি নদীর উপর দিয়ে। শুধুমাত্র একটি প্রকৌশল বিস্ময় নয়, হাওড়া ব্রিজ একটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যা কলকাতার পরিচয় বহন করে।
ইতিহাস ও নির্মাণকাল
হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের ভাবনা আসে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যখন কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। সে সময় হাওড়া ও কলকাতার মধ্যে চলাচল ক্রমশ বাড়ছিল, ফলে একটি স্থায়ী সংযোগের প্রয়োজন ছিল।
প্রথম দিকে ১৮৭৪ সালে একটি ভাসমান পন্টুন সেতু নির্মিত হয়। তবে এটি স্বল্পমেয়াদী সমাধান ছিল এবং নদীর স্রোত ও নৌপরিবহনকে বারবার বিঘ্নিত করত। ফলে স্থায়ী একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
নতুন সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৩৬ সালে, এবং এটি সম্পূর্ণ হয় ১৯৪২ সালে। যদিও ব্রিজটি ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া ব্রিটিশ শাসনের অধীনে হলেও এতে ব্যবহৃত সমস্ত উপকরণ এবং শ্রম ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়।
স্থাপত্য ও প্রকৌশল
হাওড়া ব্রিজ একটি ক্যানটিলিভার সেতু (Cantilever Bridge)। এটি এমন ধরনের সেতু যা কোনো ধরনের মধ্যবর্তী পিলার ছাড়াই দুই প্রান্ত থেকে প্রসারিত হয়ে নদী পেরিয়ে যায়। হাওড়া ব্রিজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এমন একটি ক্যানটিলিভার সেতু যেখানে একটিও নাট বা বল্টু ব্যবহার করা হয়নি। সবকিছু রিভেটিং (riveting) পদ্ধতিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হল:
মোট দৈর্ঘ্য: ৭০৫ মিটার (২,৩১৩ ফুট)
প্রস্থ: ৭১ ফুট
উচ্চতা: প্রায় ৮২ মিটার
প্রধান স্প্যান: ৪৫৭ মিটার
প্রতিদিন প্রায় ১ লক্ষ গাড়ি ও ১৫ লক্ষ মানুষ এই ব্রিজ ব্যবহার করেন
এই ব্রিজ নির্মাণে প্রায় ২৬,৫০০ টন স্টিল ব্যবহৃত হয়েছে, যার একটি বড় অংশ ছিল টাটা স্টিল কর্তৃক সরবরাহকৃত।
সমাজ ও সংস্কৃতিতে হাওড়া ব্রিজ
হাওড়া ব্রিজ কেবলমাত্র একটি পরিবহন ব্যবস্থার অংশ নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় এই ব্রিজকে দেখানো হয়েছে, যেমন:
"সীমাবদ্ধ" (সত্যজিৎ রায়)
"পরিণীতা"
"কাহানি"
"গুন্ডে"
এই ব্রিজের দৃশ্যমানতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেক পর্যটক কলকাতায় এসে প্রথমেই এই ব্রিজ দেখতে চান। হাওড়া স্টেশন থেকে নেমেই এটি চোখে পড়ে, এবং রাতের আলোয় সজ্জিত এই ব্রিজ এক অপূর্ব সৌন্দর্য প্রকাশ করে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
হাওড়া ব্রিজ কলকাতার অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ব্যস্ততম যানবাহন চলাচলের পথ। হাওড়া রেল স্টেশন, যেটি ভারতের অন্যতম ব্যস্ত রেল স্টেশন, ঠিক ব্রিজের পাশেই অবস্থিত। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী রেল থেকে নেমে এই ব্রিজ পার হয়ে কলকাতায় প্রবেশ করেন।
পণ্য পরিবহন, ট্রাক চলাচল, বাস এবং ট্যাক্সি পরিষেবায়ও এই ব্রিজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু হাওড়া ও কলকাতা নয়, বরং পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে।
রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিক চ্যালেঞ্জ
সময়ের সাথে সাথে হাওড়া ব্রিজের উপর চাপ বেড়েছে। ভারি যান চলাচল, দূষণ, এবং প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি ব্রিজের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট ও ভারতীয় প্রকৌশল সংস্থা নিয়মিত এর রক্ষণাবেক্ষণ করে।
আধুনিক কিছু চ্যালেঞ্জ:
স্টিলের ক্ষয় রোধ
অতিরিক্ত যানজট
অবৈধ বিজ্ঞাপন ও পোস্টার লাগানো
বায়ু ও জল দূষণ
তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সময়ে সময়ে বড় মেরামতির কাজ করা হয়েছে। ২০০৫ সালে একটি বড় রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রিজের নিচের অংশ পরিষ্কার এবং রং করা হয়।
পর্যটন ও জনপ্রিয়তা
হাওড়া ব্রিজ এখন শুধুমাত্র একটি সেতু নয়, এটি পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু। দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এটি দেখতে আসেন। ব্রিজটি নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নদী, নৌকা ও সিটি স্কেপের এক অপূর্ব দৃশ্য প্রদান করে।
কিছু জনপ্রিয় কার্যক্রম:
হুগলি নদীতে বোটিং
প্রাতঃভ্রমণ ও সানরাইজ দেখা
হাওড়া স্টেশনের পাশ থেকে ব্রিজের ছবি তোলা
নাম পরিবর্তন: রবীন্দ্র সেতু
১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার হাওড়া ব্রিজের নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্র সেতু রাখে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। যদিও সরকারিভাবে এটি রবীন্দ্র সেতু, তবুও সাধারণ মানুষ এখনও একে “হাওড়া ব্রিজ” নামেই ডাকেন।
উপসংহার
হাওড়া ব্রিজ শুধু একটি সেতু নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি শহরের স্পন্দন। এটি কলকাতার অচল অংশ এবং এক বিশাল সাংস্কৃতিক পরিচয়। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, উপনিবেশিক অতীত এবং আধুনিক ভারতের জীবন্ত চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজ ভবিষ্যতেও এমনভাবেই শহরের প্রতীক হয়ে থাকবে।
Photo Credit - Mihir Roy