18/07/2025
ঠিক একশ পাঁচ বছর আগে ১৯২০ সালের ঘটনা। সামনে যেন স্বয়ং যিশু, রবীন্দ্রনাথকে দেখে নতজানু লন্ডনের কফি বিক্রেতা।
রবীন্দ্রনাথকে স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট বলে ভুল করেছিলেন কোন এক ইংরেজ। লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের জীবনের এমনই ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়।
তখন ১৯২০ সাল। নোবেলজয়ী কবি বিশ্বযাত্রার অংশ হিসাবে তখন লন্ডনে উপস্থিত। আর ওকালতি পড়ার উদ্দেশ্যে তখন লন্ডনেই রয়েছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রও ছিলেন তপনমোহন। বন্ধু উইলি পিয়ারসন খবর দিয়েছিলেন গুরুদেব লন্ডন আসছেন। রবীন্দ্রনাথের সেবার লন্ডনযাত্রায় আতিথেয়তার ভার নিয়েছিলেন কবিবন্ধু রটেনস্টাইন। কেনসিংটন প্যালেস ম্যানসনে থাকার বন্দোবস্ত করা হল রবীন্দ্রনাথের। আর ঘটনাচক্রে বাড়িটি তপনমোহনের বাড়িরও একদম কাছে। শুধু তাই নয়, তপনমোহনের বাড়ি থেকে জনের ক্যাবস্টল যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে কেনসিংটন প্যালেস।
জন ধর্মপ্রাণ দরিদ্র খ্রিস্টান। আর ক্যাবস্টল বলতে চারচাকার উপর কাঠের ছোট্ট ঘর। যেখানে বসে জন বিক্রি করতো কফি, ডিমসেদ্ধ, হ্যাম স্যান্ডুইচ এইসব টুকিটাকি। পড়াশুনোর ফাঁকে আড্ডা ও জলখাবারের উদ্দেশ্যে তপনমোহন যেতেন জনের ক্যাবস্টলে।
রাত তখন বারোটা। রটেনস্টাইনের বাড়ি থেকে ফিরছেন রবীন্দ্রনাথ। ট্যাক্সি থেকে নেমেই পড়লেন বিপাকে। জোব্বার এ’পকেট ও’পকেট হাতড়ে কানাকড়ি কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না। অন্যমনস্ক রবীন্দ্রনাথ সেদিন শূন্য পকেটেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। এখন ট্যাক্সির ভাড়া মেটাবেন কীভাবে? এত রাতে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে ডাকতে হলে সে আর এক বিপত্তি। এমন সময় তপনমোহনকে দেখতে পেলেন। গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, “এই, তোর পকেটে কিছু আছে নাকি? না, আমারই মতন একেবারে শূন্য?” তপনমোহন দেখলেন ট্যাক্সির মিটারে ভাড়া উঠেছে দেড় শিলিং। তার সঙ্গে আরো ছয় পেনি যোগ করে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন তিনি।
ছাত্রের সঙ্গে বহুদিন পর দেখা রবীন্দ্রনাথের। তাঁর পড়াশুনোর খবর নিলেন। গল্পগুজব করলেন। আর কথায় কথায় তপনমোহন জানালেন এত রাতে বাইরে বেরোনোর উদ্দেশ্য জনের স্টলে এককাপ গরম কফি। ছাত্রের অনুরোধেই জনের স্টলের দিকে এগোলেন রবীন্দ্রনাথ।
স্টলের কাছাকাছি আসতেই গুরুদেবকে একটু পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন তপনমোহন। জনকে গুছিয়ে বলতে হবে গুরুদেবের পরিচয়। আপ্যায়নের ত্রুটি যেন না থাকে। রাত অনেক হয়েছে। জনের স্টলে একটিও খরিদ্দার নেই। কিন্তু স্টলের কাছে পৌঁছতেই এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখলেন তিনি। জন যেন একেবারে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। আর তার চোখের দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের উপর স্থির হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ তখন মাথা থেকে মখমলের টুপি খুলে ফেলেছেন। মৃদু একটু চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখের উপর। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাঁটু গেড়ে নিলডাউনের ভঙ্গিতে বসে পড়েছেন জন। তার হাতদুটো জোড় করা।
রবীন্দ্রনাথ ততক্ষণে অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছেন সেই জায়গা থেকে। এদিকে লন্ডনের রাস্তাঘাট তিনি ভালোমতন চেনেন না। তাঁকে কেনসিংটন প্যালেস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আবার জনের ক্যাবস্টলে ফিরে এলেন তপনমোহন। তাঁকে দেখেই জন বলে বসলেন, “চ্যাটার্জি, আমার জীবন ধন্য। করুণাময় লর্ড জিসাস ক্রাইস্ট দূর থেকে আজ আমাকে দর্শন দিয়ে গেছেন। আমার জীবন সার্থক।” জনের মুখে তখন অপার শান্তি। আর বিস্ময়ে অভিভূত তপনমোহন সেই রাতে কিছু না খেয়েই বাড়ি ফিরে এলেন।
মানুষের শরীরেই রবীন্দ্রনাথ এদেশের অনেকের কাছেই তো ঈশ্বরের সমার্থক। তাঁর লেখায়, তাঁর জীবনে আশ্রয় নিয়েই বেঁচে থাকেন কতজন। কিন্তু লন্ডন শহরের বুকে একজন কফি বিক্রেতার কাছেও যে তিনি প্রথম দেখাতেই ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন, এমন ঘটনা সত্যিই আশ্চর্য করে।
(Courtesy: )