21/05/2025
তখন গভীর রাত। হাসপাতালে রয়েছেন জনা কয়েক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী। এমন সময় এক রোগী এলেন। রীতিমতো কাতরাচ্ছেন। মেডিসিন বিভাগের এক তরুণ বাঙালি চিকিৎসক এগিয়ে এলেন তখন। একটু পরীক্ষা করেই বুঝলেন, বড়ো কিছু হয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে 'অবস্ট্রাকশন অফ দ্য ইন্টারস্টেইনস'। অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্য উপায়ও নেই। এদিকে অত রাতে ওই হাসপাতালে কোনো সার্জন নেই। তাহলে কী করে হবে অপারেশন! এদিকে রোগীর অবস্থা তো খারাপের দিকে যাচ্ছে। মনস্থির করে নিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার। তরুণ এবং মেডিসিনের ডাক্তার তো কি হয়েছে, একজন রোগীকে এভাবে ফেলে চলে যাবেন! নিজেই করলেন অপারেশন। বাঁচিয়েও তুললেন সেই রোগীকে..🌻
নীলরতন সরকারের জীবনে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তিনি এমন এক সময় ডাক্তারি করতে আসেন, যখন সাহেবদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য। নেটিভ ডাক্তারদের যেন ভূমিকাই নেই। সেই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও ডাঃ নীলরতন সরকার ছিলেন উজ্জ্বলতম নাম। ধনী থেকে গরিব— সকলের কাছে তিনি ছিলেন ভগবান। শুধু চিকিৎসায় নয়, ডাক্তারের অমন মধুর ব্যবহারই কত রোগীকে এমনিই ঠিক করে দেয় !
জন্মেছিলেন ডায়মন্ড হারবারে। উপকূল এলাকায় বাড়ি, কাজেই দুর্যোগের আশঙ্কা তো থাকতই। হলোও সেটা। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়ল বাড়ি। সহায়- সম্বলহীন অবস্থায় বাবা মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন নীলরতন। যখন ১৪ বছর বয়স, তখন নিজের চোখের সামনে মা-কে মারা যেতে দেখলেন। অসহায় হয়ে দেখলেন সাধারণ মানুষের অসহায়তা। টাকার অভাবে এভাবে কত মানুষের জীবন চলে যায়। সেই মুহূর্ত থেকেই জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার হতেই হবে, সাধারণ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াতেই হবে।
ভর্তি হয়েছিলেন শিয়ালদহের ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে। কিন্তু বাড়ির অবস্থা তো ভালো নয়। বাধ্য হয়ে নিজেও শুরু করলেন কাজ। শিক্ষকতা, দারোয়ানির কাজ— কি না করেননি! সেই সময় ব্রিটিশদের পক্ষপাতিত্ব দেখে রেগে মেগে ডাক্তারি পড়াই ছেড়ে দেন। কেন একইরকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে না ভারতীয়দের, এটাই ছিল প্রশ্ন। শিক্ষকতার কাজকেই গ্রহণ করলেন। কিন্তু ডাক্তারি যে তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ; কী করে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন! অতঃপর, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবি পাশ করলেন।
সালটা ১৮৯০, তখন থেকেই তাঁর মেধা ও দক্ষতা দেখে মুগ্ধ অনেক সিনিয়রও…🌿
প্রশান্ত মহলানবীশ থেকে বিধান রায়— নীলরতন সরকারের সম্পর্কে কথা বলতে এলে একটা জিনিস একই থাকত। সেটা তাঁর মহানুভবতা। চিকিৎসায় কোনো উঁচু-নিচু বিভেদ রাখতেন না। সেই সময় ব্রিটিশ ডাক্তারদের ভিজিট অনেক বেশি ছিল। সেই তুলনায় নেটিভ ডাক্তারদের অনেক কম। এই ব্যাপারটাই ভেঙে দিয়েছিলেন নীলরতন। দেশীয় চিকিৎসক হয়ে প্রথম ইংরেজদের সমান ভিজিট নির্ধারণ করলেন। সবাই অবাক হয়ে গেলেও, বদলটা শুরু হল সেখান থেকে। ডাক্তার বললে তখনকার মানুষদের এই একটাই নাম মাথায় আসত। যখনই কোনো সমস্যা হয়েছে, সমাধান একটাই— ডাঃ নীলরতন ! কত জনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন ! গরীবদের কাছে তিনিই ছিলেন 'মসিহা'..💫💛
তিনিও সর্বস্ব দিয়ে সেবা করতেন। নিজে রোজগারও করেছিলেন অনেক। সমস্তটা দিয়ে দিয়েছিলেন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান, গবেষণা ও শিল্পের উন্নতিতে। নিজের বাড়িতেই শুরু করেছিলেন ল্যাবরেটরি। নীলরতন সরকারের হাত ধরে ভারতে অনেক জিনিসের প্রবর্তনও হয়। ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাফ, যা আজকে বহুল ব্যবহৃত হয় ; এই যন্ত্রটা ভারতে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন নীলরতন সরকারই। তিনিই প্রথম দাই-দের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেন, যাতে সদ্যোজাত মৃত্যুর হার কমে। এমনকি বাংলায় ডাক্তারি পড়ানো নিয়ে রাধাগোবিন্দ করের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
এই স্বদেশি কলেজ শুরুর সময় ছোটলাট কারমাইকেলের কাজে সাহায্য চাইতে গেছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার। একথা সেকথা বলে কারমাইকেল জানালেন, কোষাগারের অবস্থা ঠিক নেই। কাজেই নীলরতন যদি এক লাখ টাকা জোগাড় করে আনেন সেটা ভালোই হয়। ভেবেছিলেন ব্যাপারটা এড়ানো গেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম যে নীলরতন সরকার। সমাজে তাঁর নাম তখন শিখরে। এক মাসের মধ্যে শহরের ধনীদের থেকে জোগাড় করলেন এক লাখ টাকা; আজকের হিসেবে যা কয়েক কোটির সমান।
হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই ছিলেন ডা. নীলরতন সরকার (Nilratan Sircar)। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি..🌷